অবরোধ-হরতাল শুরুর পর থেকে বিগত ৩৭ দিনে সারাদেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অন্তত ১৩,০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
আর এই সময়ে মামলা হয়েছে সাত শতাধিক। ধরপাকড়ের কারণে দেশের কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দির সংখ্যা এখন ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ।
কারা সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক নিয়মে দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ বন্দি থাকে। অবরোধ শুরুর পর কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ সময় সাধারণ অপরাধের আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে খুবই কম। এক মাসে যেসব বন্দি কারাগারে এসেছে, তাদের ৮০ শতাংশই রাজনৈতিক মামলার আসামি।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, গত ৩৭ দিনে পেট্রোল বোমাসহ নানা উপায়ে ১,০৪৯টি যানবাহন ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার অভিযোগ বিভিন্ন থানায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।
আর চলমান এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে পুলিশের বাজেটে টান পড়েছে। ঘাটতি মেটাতে আগামী তিন মাসের জন্য ১২৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছে পুলিশ।
শুকনো খাবার, অতিরিক্ত সময় কাজ করা, আসামির খোরাকি, যানবাহনের তেল ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য এ অর্থ চাওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পুলিশের চিঠিতে বলা হয়, হরতাল-অবরোধ মোকাবিলায় পুলিশ বাহিনীর ৯৪,৯৪৯ জন সদস্য দায়িত্বে থাকছেন। এ সময় জনপ্রতি খাবার সরবরাহ বাবদ গড়ে দৈনিক ৭৫ টাকা করে দরকার হচ্ছে। এতে দৈনিক মোট ৭১ লাখ ২১ হাজার ১৭৫ টাকার প্রয়োজন। এ হিসাবে আনুমানিক তিন মাসের জন্য দরকার ৬৪ কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার ৭৫০ টাকা।
এর মধ্যে খাবার সরবরাহের জন্য পুলিশের কাছে ২০ কোটি ৮০ লাখ ৭৫,০০০ টাকা তহবিলে আছে। মোট চাহিদা থেকে এ অর্থ বাদ দিয়ে আরো ৪৩ কোটি ২৮ লাখ ৩০,৭৫০ টাকা দরকার।
পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান বলেছেন, চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় কাজ করতে হচ্ছে। এজন্য আনুষঙ্গিক কিছু সুবিধা বাড়াতে হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই আছে।
পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশব্যাপী সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। গত ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অপরাধবিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যে এ উদ্বেগের কথা ফুটে ওঠে।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের বর্ষপূতির সমাবেশ ঘিরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করা হয়। এরপর ৫ জানুয়ারি তিনি সারাদেশে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
৬ জানুয়ারি টানা অবরোধ শুরুর পর থেকেই সারাদেশে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। এর তিন সপ্তাহ পর বর্ডার গার্ডকে (বিজিবি) সঙ্গে নিয়ে যৌথ অভিযান শুরু করে পুলিশ। এ সময়ে যে ১৩,০০০ গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই বিএনপি-জামায়াতের কর্মী।
অভিযানের প্রথম পর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাহায্য নিয়ে থানাগুলোতে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিএনপি-জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের নামের তালিকা করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী যাকে যেখানে পাওয়া যায়, গ্রেপ্তার করা হয়।
তালিকা ধরে বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালানো হয়। তবে অভিযানের সময় এদের বেশির ভাগ পলাতক থাকায় গ্রেপ্তার করা যায়নি। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেন্দ্রীয় থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মীরা আছেন।
পুলিশের বিরুদ্ধে এসব অভিযানের নামে সাধারণ মানুষকে ধরে হয়রানি, মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করার অভিযোগও উঠেছে।
কারা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন যে হারে বন্দি কারাগারে আসে, প্রায় একই হারে ছাড়াও পায়। ফলে বন্দির সংখ্যা সীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু এক মাস ধরে যে হারে বন্দি আসছে, তার তুলনায় জামিনে বের হচ্ছে কম। ফলে হাজতি-বন্দির সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশব্যাপী অবরোধ শুরু হওয়ার আগে ৪ জানুয়ারি দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছিল ৬৭,৬১৪ জন। ৮ ফেব্রুয়ারি এসব কারাগারে বন্দির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১,৮০২। কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার ৪৬০।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা ২,৬৮২। ১০ ফেব্রুয়ারি বন্দি ছিল ৭,৫০০ জন। ধারণক্ষমতার চেয়ে বন্দির সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেশি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট কারা কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে বন্দির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) সৈয়দ ইফতেখার আহমেদ বলেন, তিন গুণের মতো বন্দি থাকায় ঢাকা কারাগারের ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হচ্ছে। শুক্র ও শনিবার কিছু বন্দিকে কাশিমপুর কারাগারে সরিয়ে চাপ সামলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, ৫ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১,০৪৯টি যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৭৯টি বাস ও ট্রাকে।
বোমা ছাড়াও অন্য উপায়ে আগুন দেওয়া হয় ৪৫৭টি যানবাহনে। যানবাহন ছাড়া আরো ২২টি স্থাপনায় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আর ভাঙচুর হয়েছে ৪০৩টি যানবাহন।
তবে এসব হিসাব অভিযোগের ভিত্তিতে করা হয়। পুলিশের হিসাবের বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ না হওয়ায় এসব তালিকায় আসেনি বলে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
পুলিশের হিসাবে বিগত ৩৭ দিনে মোট ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য। ৫৪ জনের মধ্যে আগুন পুড়ে মারা গেছেন ৩৭ জন। এ সময় ১,৫১৫টি ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগ রেকর্ড করা হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫০৭ জন।
পুলিশের হতাহতের বিবরণ থেকে জানা গেছে, এ সময় দুজন পুলিশ সদস্য নিহত ও ২৭৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তবে পুলিশের হিসাবের সঙ্গে গণমাধ্যমে আসা তথ্যের অমিল রয়েছে। বুধবার পর্যন্ত প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ক্রসফায়ারে নিহত ২৯ জনসহ মোট মৃতের সংখ্যা ৯৭।