টিঅ্যান্ডটি, মুঠোফোন ও তারবিহীন পিএসটিএনসহ সব ধরনের টেলিফোন গ্রাহকের কথোপকথন, ভয়েস ও ডাটা রেকর্ড করা হচ্ছে। তবে তা সংরক্ষিত থাকছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সরকারের নির্দেশে ৬টি মুঠোফোন অপারেটর, বিটিসিএল ও ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জগুলো (আইসিএএক্স) বাধ্যতামূলকভাবে এ রেকর্ড করছে। আন্তর্জাতিক কলের আদান-প্রদান রেকর্ড করছে আইসিএক্স। অভ্যন্তরীণ কলগুলো রেকর্ড করছে সংশ্লিষ্ট অপারেটর। একই সঙ্গে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টেলিফোনের কথোপকথন ও ডাটা রেকর্ড করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে বিটিসিএলসহ ২৬টি আইসিএক্স অপারেটর আছে দেশে। ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েগুলো (আইজিডব্লিউ) বিদেশী যেসব শ্রেণীর কল আনা-নেয়া করছে সেগুলো বিটিসিএলসহ ২৬টি আইসিএক্স অপারেটরের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন অপারেটরের কাছে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে টেলিফোনের দু’পক্ষের গ্রাহকের সঙ্গে কি কথোপকথন ও ডাটা বিনিময় হচ্ছে তা ধারণ হয়ে যাচ্ছে আইসিএক্স সার্ভারে।
মোবাইল কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নির্দেশে প্রত্যেকটি অপারেটর ইতিমধ্যে তাদের গ্রাহকদের ভয়েস ও ডাটা রেকর্ডের জন্য বিশেষজ্ঞ টিমের নেতৃত্বে একটি নতুন বিভাগ খুলেছে। ওই নির্দিষ্ট বিভাগটি দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে। তারা প্রতিনিয়ত সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া চাহিদা পূরণ করে চলছে। সরকার থেকে যখন কোনো গ্রাহকের নম্বর সম্পর্কে তথ্য ও লোকেশন জানতে চাওয়া হচ্ছে মুহূর্তে সেগুলো তারা সরবরাহ করছে। সার্ভারে রেকর্ড রাখছে। এসব কাজে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো নিজ উদ্যোগে কোটি কোটি টাকার মেশিনপত্র ও সার্ভার সংযোজন করেছে বলেও জানা গেছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সেখানে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করে যাচ্ছেন। বিটিআরসির একটি টিম মুঠোফোন অপারেটর ও পিএসটিএন অপারেটরদের এই বিভাগটির কার্যক্রম মনিটরিং করছে।
বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারের প্রয়োজনে রেকর্ডকৃত এসব ডকুমেন্ট থেকে সংশ্লিষ্টদের তথ্য প্রতিনিয়ত যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এসব ডকুমেন্টের সঙ্গে সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড, বোমাবাজি সংক্রান্ত কোনো কথা, জঙ্গি সংগঠন ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী ও চোরাকারবারির সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। এছাড়া কথোপথন ও এসএমএসগুলোতে (ক্ষুদে বার্তা) অপহরণ, চাঁদাবাজি ও খুনের পরিকল্পনার সঙ্গে কারও কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অপরদিকে সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কিছু কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা বা গোষ্ঠীর টেলিফোনে আড়ি পাতছে। এজন্য তাদের নিজস্ব মেশিনপত্র ও সরঞ্জমাদি রয়েছে। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এসব টেলিফোনে আড়ি পাতছে গোয়েন্দারা। এজন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে সাময়িকভাবে স্থাপন করা হয়েছে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি। সেখানে পুলিশ, এসবি, এনএসআই আলাদা কক্ষে মুঠোফোন ও টিঅ্যান্ডটি ফোনে আড়ি পাতছে। আড়িপাতার এই প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে আলাদা দফতর করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এদিকে টেলিফোনে আড়িপাতা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথক দফতর করা হলেও তা এখনও চালু হয়নি। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামে নতুন এ সংস্থাটি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনও হয়নি। ইতিমধ্যে এ দফতরের পদ সৃষ্টিসহ নিয়োগবিধি প্রণয়ন চূড়ান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে টেলিফোনে আড়িপাতার ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। জানা গেছে, এনটিএমসির কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় এখনও সংশ্লিষ্ট অপারেটর, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম চালাচ্ছে। আড়িপাতার জন্য গোয়েন্দা দফতরে আগে যে কেন্দ্রটি ছিল তার মাধ্যমে একসঙ্গে ৫ হাজার মুঠোফোনে আড়িপাতা যেত। সম্প্রতি এই শক্তি আরও বাড়ানো হয়েছে। এখন একসঙ্গে ১০ হাজারের বেশি ফোনে আড়িপাতা যাচ্ছে।
আড়িপাতা আইনে যা আছে : বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইন-২০০১ এ সরকারকে টেলিফোনে আড়িপাতার ক্ষমতা দেয়া আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃংখলার স্বার্থে এ আইনের ৯৭ক ধারায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃংখলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে এবং এ কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারবে এবং পরিচালনাকারী ওই নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে।’ এ আইনে টেলিফোনে আড়িপাতার দণ্ড সংক্রান্ত ৭১ ধারায় বলা হয়েছে, ব্যক্তি যদি অপর দু’জন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ি পাতেন তাহলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির এই কাজ হবে একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২০০৬ সালে এ ধারায় সংশোধনী এনে এর সঙ্গে অপর একটি প্যারা জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭ক-এর অধীন সরকার হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না।’ অর্থাৎ সরকার আইনশৃংখলা বাহিনীর যে সংস্থা বা যে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেবে সে সংস্থা বা সে ব্যক্তি টেলিফোনে আড়ি পাততে পারবেন।