বিশেষ প্রতিনিধি : জমির টেলিকমের সাথে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানী লিমিটেড এর (বিটিসিএল) আচরণে বৃটিশ পার্লামেন্টের বিভিন্নদলের একাধিক এমপি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, একটি সফল ব্যবসায়িক কোম্পানীকে এভাবে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া যায়না। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে একটি সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত চরম হুমকীর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাঁরা (বৃটিশ এমপিরা) যুক্তরাজ্য সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবেন। বৃটিশ সাংসদরা জমির টেলিকমের সিগন্যাল লিংক পুনঃস্থাপন করে তাদেরকে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
১৫ জুলাই মঙ্গলবার সকালে বৃটিশ পার্লামেন্টের কমিটি কক্ষে পপলার এন্ড কেনিংটাউন আসনের এমপি সাবেক লেবার মিনিস্টার জিম ফিটজপ্যাট্রিক এর উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ আহবান জানানো হয়। এতে বক্তব্য রাখেন ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ দলের এমপি ডেভিড ব্যারোজ ও জমির টেলিকম এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নওফেল জমির। সংবাদ সম্মেলনে জিম ফিটজপ্যাট্রিক এমপি জানান, তিনি ও ডেভিড ব্যারোজ এমপিসহ বৃটিশ পার্লামেন্টের ১২জন মন্ত্রি ও এমপি উক্ত ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জমির টেলিকমের পাশে দাড়িয়েছেন। তাঁরা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। লন্ডন সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে তাঁরা এ ব্যাপারে কথা বলবেন বলে জানান।
জিম ফিটজপ্যাট্রিক এমপি আরো বলেন, জমির টেলিকমের কার্যালয় ক্যানারী ওয়ার্ফে। এই এলাকা তাঁর নির্বাচনী আসনের অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় তিনি তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে তাদের সমস্যার কথা জানতে পারেন। ইতোমধ্যে জমির টেলিকমের সংযোগ পুনঃস্থাপনের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বৃটিশ হাইকমিশন ও বৃটিশ ফরেন অফিসে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সšু‘ষ্টজনক জবাব পাননি। তিনি বলেন, জমির টেলিকমের মতো একটি ফার্স্ট গ্রোয়িং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে হুমকীর মধ্যে ফেলে দেওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্চেছ। এ ঘটনা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে।
অনুষ্ঠানে ডেভিড ব্যারোজ এমপি প্রেসকনফারেন্স আয়োজনের জন্য জিম ফিটজপ্যাট্রিক এমপিকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, জমির টেলিকমের সাথে অন্যায় আচরণের বিষয় সম্পর্কে পার্লামেন্টের বিভিন্ন দলের এমপিরা অবগত আছেন। তারা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জমির টেলিকমের অধীনে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে শতাধিক লোক চাকরি করে থাকেন। সরকার কোম্পানীর সংযোগ বিচ্চিছন্ন করে দেয়ায় তাদের চাকরি এখন হুমকীর মুখে। একটি ফার্স্ট গ্রোয়িং কোম্পানীকে এভাবে ধ্বংস হতে দেওয়া যায়না। তিনি এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
জমির টেলিকমের বাংলাদেশের সিগন্যাল লিংক বন্ধ করার ঘটনায় অন্য যেসকল বৃটিশ এমপি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা হলেন, সাবেক পরারাস্ট্রমন্ত্রী স্যার মালকম রিফকিন্ড এমপি, হোম অফিস মিনিস্টার জেইমস ব্রোকেনশায়ার, লেবার পার্টির ডেপুটি লিডার হ্যারিয়েট হারমান এমপি, জাস্টিস মিনিস্টার সায়মন হিউজ এমপি, শ্যাডো এটর্নি জেনারেল ইমিলি থ্রোনবেরী, জাস্টিস সেক্রেটারির সংসদ বিষয়ক সেক্রেটারি লি-স্কট এমপি, কনজার্ভেটিভ পার্টির এমপি মেথিউ অফর্ড, অলপার্টি পার্লামেন্টারী গ্রুপ ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি, কেবিনেট মিনিস্টার ইয়েন ডানকান স্মিথ এমপি ও লেবার পার্টির এমপি মাইক গেইপস। তাঁরা ইতোমধ্যে বৃটিশ ফরেন সেক্রেটারি, ইউকে টিআইর প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের সংশ্লিস্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে চিঠি লিখেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জমির টেলিকমের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নওফেল জমির বলেন, বিটিসিএল আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক যোগাযোগের বিষয়টি চিন্তা করে জমির টেলিকমের সঙ্গে ন্যায়নুগ আচরণ করবে এটাই আমরা আশা করি। হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থে তিনি ও তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপন করে তদন্তের নামে হয়রানি না করে বরং বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নওফেল জমির বলেন, বিটিসিএল আমাদের কাছে কোনো বকেয়া বিল পাবেনা। আমরা তাদের সকল বিল সময়মতো পরিশোধ করেছি। তিনি বলেন, বিল বকেয়া থাকলে উচ্চ আদালত আমাদের কোম্পানীর সংযোগ পুনঃস্থাপনের নির্দেশ দিতেন না। উচ্চ আদালতের রায়ই প্রমাণ করে আমাদের বিরুদ্ধে বকেয়া বিলের অভিযোগ অহেতুক ও কাল্পনিক। তিনি বলেন, বিটিসিএল কোন সময় কার বিল কার ঘাড়ে ছেপে দেয় বুঝা মুশকিল। একবার সৌদির একটি কোম্পানীর মোটা অংকের বিল অনাদায়ী থাকার অভিযোগে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে সংযোগ পুনঃস্থাপনে বাধ্য হয়। আমি তো আর সৌদি কোম্পানীর মতো নয়। তাই আদালতের নির্দেশ অমান্য করে আমার কোম্পানীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, সরকার আমাকে ব্যবসা থেকে সরিয়ে দিয়ে এই মার্কেট একটি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিতে চায়।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের মার্চ মাসে হঠাৎ করেই বিটিসিএল জমির টেলিকমের আন্তর্জাতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। লন্ডনভিত্তিক কোম্পানী জমির টেলিকম ২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্যসহ বহির্বিশ্বের আন্তর্জাতিক টেলিফোন কল বাংলাদেশে প্রেরণ করছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জমির টেলিকমের সঙ্গে বিমাতাসূলভ আচরণ শুরু করে বিটিসিএল। ইনভয়েসিং এবং পেমেন্টকে কেন্দ্র করে বিটিসিএল ২০১০ সালে একবার জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তখন বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ালে আইনি লড়াই শুরু হয়। হাইকোর্ট বিভাগ তখন জমির টেলিকমের সংযোগ স্থাপনের জন্য বিটিসিএলকে নির্দেশ দেয়। উচ্চ আদালতের এক রুলিংয়ে মামলার চুড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংযোগ অব্যাহত রাখতে বলা হয় বিটিসিএলকে। এছাড়া এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন আদালতেও একটি মামলা চলমান রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় গত মার্চ মাসে হঠাৎ করেই আবার জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় বিটিসিএল। এই বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগ এবং আরবিট্রেশন আদালতের দৃষ্টিতে আনা হয়। তখন আবারো নির্দেশ দেওয়া হয় সংযোগ পুনঃস্থাপনের জন্য। কিন্তু বিটিসিএল সংযোগ না দিয়ে বরং নানা কৌশল অবলম্বন শুরু করে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের এক বিচারপতির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিটিসিএল মামলার গতি ধীরকরণের কৌশল নেয়।
এদিকে বিটিসিএল-এর সঙ্গে জমির টেলিকমের আইনি লড়াই চলমান থাকা অবস্থায় সরকার হীন উদ্দেশ্যে ভিন্ন একটি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়। দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করে সরকার জমির টেলিকমের সুনাম ক্ষুন্নের নতুন কৌশল নেয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই জমির টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওফেল জমির এবং তাঁর ভাই নওশাদ জমিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করা হচ্চেছ।
বৃটিশ রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ী মহলের উদ্বেগ:
বৃটিশ মিডিয়া এনিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যার ফলে বিষয়টি রাজনীতিক মহল এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রভাবশালী সদস্য ইমিগ্রেশন অ্যান্ড সিকিউরিটি মিনিস্টার জেমস্ ব্রোকেনশায়ার এমপি বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় কমনওয়েলথ মিনিস্টার সাঈদা ওয়ার্সির কাছে চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে জমির টেলিকমের বিষয়ে নিরপেক্ষ, ন্যায় এবং জবাবদিহিমূলক আচরণ নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ বিষয়ক অলপার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অ্যান মেইন এমপি নিশ্চিত করেন, আইন অমান্য করে বিটিসিএল কর্তৃক জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের বিষয়টি যুক্তরাজ্য সরকারকে অবহিত করেছেন। এ বিষয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রির সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, জমির টেলিকমের সঙ্গে বিটিসিএল-এর অন্যায় আচরণের বিষয়ে লিখেছেন এবং সরকারের কাছ থেকে দ্রুত জবাব আশা করছেন। একই সঙ্গে জমির টেলিকমের সঙ্গে ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণের জন্যও মন্ত্রিকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ
এদিকে জমির টেলিকমের সাথে বিটিসিএল-এর এই আচরণে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আইন লঙ্ঘন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বাজার হিসাবে বাংলাদেশের উত্থানকে এই ঘটনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের একজন প্রতিষ্ঠিত বিনিয়োগকারী এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জমির টেলিকমের সাথে বিটিসিএল-এর আচরণ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সতর্ক সঙ্কেত। এটি বিনিয়োগকারী এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছে। এতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।
ওই ব্যবসায়ী বলেন, লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জমির টেলিকমের সাথে বিটিসিএল-এর এই বিমাতাসূলভ আচরণ দেশের কোনো উপকারে আসছে না। আইন লঙ্ঘন করে জমির টেলিকমকে এরকম হুমকি-ধমকি যুক্তরাজ্য ভাল চোখে দেখছে না। বাংলাদেশ সরকার যদি মনে করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাজারে এর কোনো প্রভাব ফেলবে না, তাহলে সরকার ভুল করবে।