ইতিহাসের পাতায় আবারো বাঙালী
ইব্রাহিম খলিল : গত ৬ মাস আগে যখন বৃটেনের স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুুতি চলছিলো তখন বিলেতের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া তার স্বাক্ষাৎকারে লুৎফুর রহমান বলেছিলেন, ’জনগনের সেবা ও সঠিক নেতৃত্ব দিতে কোন দলের প্রয়োজন নেই। যে প্লাটফর্মে থেকে ন্যায় ও নিজের সঠিক মতামত প্রকাশ করা যায়না সেই প্লাটফর্মে আমি লুৎফুর রহমান থাকতে চাইনা। ৬ মাস আগে দেওয়া তার এই কথার প্রমান দিলেন জনগনের মেয়র লুৎফুর রহমান। টানা দ্বিতীয়বারের মতো সর্বোচচ সংখ্যাক ভোট পেয়ে বৃটেনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে একমাত্র নির্বাচিত মেয়র হওয়র মধ্য দিয়ে বৃটিশ রাজনীতিতে আবারো ইতিহাস সৃষ্টি করলেন এই ক্যারেশমেটিক নেতা। এর মাধ্যমে প্রমান হয়েছে কোন দল নয় বরং নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়েই জনগনের মন জয় করা যায়।

লুৎফুর রহমানের মেয়র হওয়ার ঘোষনাটি যখন আসে তখন লন্ডনে ঘড়ির কাটায় রাত দেড়টা। নানা নাটকিয়তা ও হিশেব নিকেশের পর আসে বিজয়ের ঘোষনা। মোট ৩৭ হাজার ৩৯৫ ভোট পেয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো তিনি নির্বাচিত হন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র। প্রথম ধাপে তিনি পান ৩৬ হাজার ৫৩৯টি ভোট। যা মোট ভোটের ৪৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী লেবার পার্টির জন বিগস পান ৩৪ হাজার ১৪৩ ভোট। তবে নির্বাচনে কোন প্রার্থীই মোট ভোটের ৫১ শতাংশ ভোট না পওয়ায় দ্বিতীয় ধাপে ভোট গননা শুরু হয়। দ্বিতীয় ধাপের ভোট গননা শেষে প্রায় ৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। বৃহস্পতিবার টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এই নির্বাচনে মোট ভোট পড়ে ৮৬ হাজার ৪০২টি। । যা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুন।
টাওয়ার হ্যামলেটসে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন মোট ১০জন প্রার্থী এর মধ্যে লুৎফুর রহমান ছাড়াও ছিলেন আরো ৪ বাঙালী। এর মধ্যে লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রিতেন্দ্রনাথ ব্যনাজিং পান ১,৯৫৯ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী শুয়েব পান ২০৫ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী হাফিজ আব্দুল কাদির পান ১৬২ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী মোহাম্মদ খোয়াজ আলী খান পান ১৬৪ ভোট, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী ক্রিস ইউলফোর্ড পান ৭,১৭৩ ভোট, ইউকে ইন্ডিপেন্ডেট পার্টির প্রার্থী নিকোলাস ম্যাকুইন পান ৪,৮১৯ ভোট, ট্রেড ইউনিয়ন এন্ড সোস্যালিস্ট কোয়ালিশন থেকে হগো প্রিন্স পান ৮৭১ ভোট এবং গ্রীন পার্টির প্রার্থী ক্রিস স্মিথ পান ৪,৬৯৯ ভোট।
২০১০ সালে লুৎফুর রহমান জনগনের সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বাঙালী ও কৃষাঙ্গ হওয়ার কারনে তিনি পদে পদে হয়রানির শিকার হন। বৃটিশ মূলধারার মিডিয়া থেকে নিয়ে সকল ক্ষেত্রে বাধার সম্মোখিন হতে থাকেন বৃটেনের এথনিক কমিউনিটিতে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী এই নেতা। গত ৩১ মার্চ বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানেও তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। পরবর্তীতে সরকারী তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমানিত হন। এতো ঘাত প্রতিঘাতের পর জনগন তাকে পূরনায় নির্বাচিত করায় তাৎক্ষনিক এক প্রতিক্রিয়ায় কৃতজ্ঞতা জানান মেয়র। শুক্রবার রাতে যখন পূর্ব লন্ডনের ট্রক্সি হলে তার বিজয় হলে ভোর রাত অবধি উল্ল্যাস করেন হাজার হাজার জনতা।
এদিকে বিজয় পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে, লুৎফুর রহমান বলেন মেয়র পদটি আমার জন্য জনগনের দেওয়া গিফট। আমি অর্থ কিংবা সুনামের আশায় মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি। জনগনের সেবা ও সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এই পদে তারাই আমাকে বার বার উৎসাহিত করেছেন। শত প্রচার প্রপাগান্ডার পরও জনগন যেভাবে তাদের হদয় উজার করে দিয়ে ভালবেসে আমাকে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়েছেন তাই প্রমান করে জনগনের কাছে কোন শক্তিই বড়ো নয়। তবে যারা তাকে ভোট দেননি তাদেরও সেবা করতে চান তিনি। এ জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন নবনির্বাচিত মেয়র।
মেয়র লুৎফুর রহমানের এই টানা বিজয়ে উচছাস প্রকাশ করেছেন টাওয়ার হ্যামলেটসের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, লুৎফুর রহমান বিগত ৪ বছরে টাওয়ার হ্যামলেটসে যে অভূতপূর্ব উন্নন করেছেন তারই প্রতিদান তার এই বিজয়। বৃটেন সরকার যখন সারাদেশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি স্কুল মিল বন্ধ করে দেয় তখন লুৎফুর রহমান তা অব্যাহত রেখেছেন। এমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট, বৃদ্ধদের জন্য ফ্রি হোম কেয়ার সুবিধা, পুরো বৃটেনে সর্বোচচ সংখ্যাক সোস্যাল হাউজ নির্মানসহ তার নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডই তাকে এই সম্মান দিয়েছে বলে তারা মতামত ব্যক্ত করেন। লুৎফুর রহমানের নেওয়া বিভিন্ন পলিসির প্রশংসা করেছেন খোদ বৃটিশ রাজনীতিবিদ, গবেষক ও বুদ্ধিজীবিরা।
মেয়র পদে বিজয়ের পাশাপাাশি লুৎফুর রহমানের গঠিত স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম টাওয়ার হ্যামলেটস ফাস্টের কাউন্সিলাররাও বিজয়ের দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছেন। এ পর্যন্ত মেয়রের টাওয়ার হ্যামলেটস ফাস্ট থেকে ১৫ জন, লেবার পার্টি থেকে ৯ জন এবং কনজারভেটিভ পার্টি থেকে ৩ জন কাউন্সিলার নির্বাচিত হওয়ার খবার পাওয়া গেছে। এক সময়ের লেবার পার্টির দুর্ঘ বলে পরিচিত টাওয়ার হ্যামলেটসের পুরো নিয়ন্ত্রন এখন লুৎফর রহমানের হাতে। বৃটেনের প্রায় ৬ শতাধিক কাউন্সিলের মধ্য মাত্র ১৩ জন মেয়র জনগনের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এর মধ্যে একমাত্র লুৎফুর রহমান হচেছন সংখ্যালঘু বা মুসলিম মেয়র। বাকী সবাই শ্রেতাঙ্গ।
London Bangla A Force for the community…

