ভেতরে টাকা বাইরে টাকা। প্রতি পদে পদে টাকা গুনতে হয় বন্দি ও তাদের স্বজনদের। টাকা না দিলে কারাগারের ভেতরে বন্দির ওপর নেমে আসে নির্যাতন আর বাইরে স্বজনকে হতে হয় হয়রানির শিকার। টাকা ছাড়া কোনো কিছুই জোটে না। টাকার বিনিময়ে কারাগারের ভেতর ভালো খাওয়া, ভালো জায়গায় শোয়া, গোসলের পানিসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। থেমে নেই মাদক ব্যবসাও। মোবাইল ফোন ব্যবহারেরও সুযোগ পাচ্ছে বন্দিরা। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, বদলোকের নাকি সরকারি কার হুকুমে চলছে কারাগার? স্বজনদের আসামি দেখতে কিংবা আসামিকে খাবার দিতেও লাগে টাকা। কারাগারের সামনে দায়িত্বরত কারারক্ষী ও সিটিএসবির সদস্যরা যেন টাকার জন্য হাঁ করে থাকেন। বন্দির স্বজনরা কারাগারের সামনে গেলেই ছোঁ মেরে ধরার প্রতিযোগিতায় নামেন তারা। জামিনে মুক্তিপ্রাপ্তদের ফের গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে কারাগারের সামনেই হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। সাক্ষাতের সিরিয়াল এগিয়ে দেয়ার নামেও বাণিজ্য চলছে। তাই ভুক্তভোগীরা বলেন, ঢাকা সেন্ট্রাল জেল যেন কিছু কিছু লোকের টাকা বানানোর যন্ত্র।
কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় কারাবিধিবহির্ভূত এসব বাণিজ্য দীর্ঘদিনের হলেও কোনো বিকার নেই। ১০ দিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সরেজমিন, জামিন ও মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আদালতে হাজিরা-শুনানি দিতে যাওয়া আসামি এবং সাক্ষাৎ করতে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কারাগারের সামনে টাকা লেনদেনের ঘটনাও চোখে পড়েছে।
‘টাকা ছাড়া কাজ হয় মিয়া! টাকা দেন। সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি দেখে বাসায় ফিরতে পারবেন।’ এ কথা কারারক্ষী সিদ্দিকুর রহমানের। গত ১ মার্চ ছবি নামে এক বন্দি মহিলাকে কারাগারে দেখতে আসা আবদুল জলিলকে কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে এভাবেই প্রস্তাব দেন ওই কারারক্ষী। এক হাজার টাকা দাবি করেন। শেষে সাড়ে ছয়শ’ টাকায় রফা হয়। টাকাটা নিয়ে চলে যান কারারক্ষী সিদ্দিকুর রহমান। অনুসন্ধান কক্ষের সামনে জলিল অবস্থান করতে থাকেন। ১২ মিনিট পর সিদ্দিকুর রহমান ফিরে এসে হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ১২টা থেকে ১২টা ৪৫-এর মধ্যে দেখা করতে হবে। জলিলের বাসা মিরপুর গুদারাঘাট এলাকায়। তার পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ছবিকে তিনি দেখতে আসেন। ছবি মহিলা ওয়ার্ডের বন্দি।
২৩ ফেব্র“য়ারি। বেলা সাড়ে ১১টা। সিটিএসবির কনস্টেবল বশির জেলগেটের পাশেই এক মহিলা ও দুই যুবককে কারাগারের ভেতর ও বাইরের দর সম্পর্কে বলছিলেন, ‘আসামির সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাইলে চার হাজার টাকা। যদি দেখা না করেন তার শরীর স্বাস্থ্যের খবর এনে দেয়া যাবে, লাগবে পাঁচশ টাকা। গোপন কথা আদান-প্রদান করে দেয়া যাবে। এ জন্য এক হাজার টাকা লাগবে। খুব সিরিয়াস বা অতি গোপন কথা হলে টাকার পরিমাণ বাড়াতে হবে। স্পেশালভাবে খাবার দিতে চাইলে লাগবে পাঁচশ’ টাকা।’ এরপরই ওই বশির বন্দির নাম, পিতার নাম ও স্থায়ী ঠিকানা একটি চিরকুটে লিখে নিয়ে তিনি জেলের ভেতরে যান। প্রায় ১৫ মিনিট পর কনস্টেবল বশির ঘুরে এসে তাদের জানালেন, আপনার আসামি তাবির হোসেন পাভেল ‘মেঘনা-৮ এ’ আছেন। তিনি হাঁটতে পারছেন না। পা ব্যান্ডেজ করা। তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে টাকা আরও বেশি দিতে হবে। কারণ তিনি হাঁটতে না পারায় দু’জন রেকার (যারা তাকে ধরে আনবে) লাগবে। রেকারদেরও টাকা দিতে হবে। অবশেষে ওই মহিলা তার স্বামী পাভেলের কাছে গোপন কথা ও খাবার পাঠানোর কথা জানান বশিরকে। আগেই তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর এনে দেয়ার জন্য পাঁচশ’ টাকা ও গোপন কথার জন্য দেড় হাজার টাকা, সব মিলিয়ে দুই হাজার টাকা দাবি করেন কনস্টেবল বশির। এত টাকা দিতে অপারগতা জানালেন বন্দি পাভেলের স্ত্রী। পরে মোট তেরশ’ টাকায় চুক্তি হয়। তাদের অনুসরণ করে এসব চিত্র দেখা যায়।
গত ২৫ ফেব্র“য়ারি বেলা ১টার দিকে এই প্রতিবেদককে সিটিএসবির পরিচয় দিয়ে এক যুবক জানতে চান, ভেতরে (কারাগারে) কোন আসামি আছে? সিস্টেম করে সব কিছু করে দেয়া যাবে। কোনো আসামি নেই জানালে তিনি হতাশ হয়ে পাশের আরেকজনের কাছে যান।
গ্রেফতারের ভয় : কারাগার থেকে জামিনে কিংবা মামলায় খালাস পেয়ে বের হওয়া ব্যক্তিদের ফের গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে গেটের সামনেই হয়রানি ও টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। মুক্তির লিস্ট ধরে কারাগারের ভেতরেও চাঁদাবাজি করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা বন্দিকে গিয়ে ‘ভয়’ দেখানো হয়, বাইরে বের হলেই আবার গ্রেফতার হবে। বন্দিকে দিয়ে ভেতর থেকে তার স্বজনদের কাছে ফোন করানো হয় টাকার জন্য। গত ২৪ ফেব্র“য়ারি হানিফ নামের এক বন্দি। জামিনে বের হওয়ার পর কারাগারের সামনেই তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সকালে এসবি পরিচয়ে এক ব্যক্তি জেলখানার ভেতরে আমার কাছে গিয়ে বলে, তোমার জামিন হয়েছে। একটু পরেই বের হতে পারবা। গেট থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফের গ্রেফতার করা হবে তোমাকে। তবে ১০ হাজার টাকা দিলে গ্রেফতার ঠেকানো যাবে।’ এরপরই এসবি পরিচয়ে ওই ব্যক্তি নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তাকে স্বজনদের কাছে ফোন করতে বাধ্য করে। গাড়ি ভাংচুর মামলায় গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে হানিফকে পল্টন থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছেন সিটিএসবি কারাজোনের কয়েকজন সদস্য, কারারক্ষী ও পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন উর রশিদের কারাগার প্রতিনিধি এএসআই শাহ আলম। তাদের সঙ্গে বাইরের দালালরাও জড়িত। ৩ মার্চ দুপুরে জামিনে বের হন উত্তরার সোহাগ। সোহাগ খিলক্ষেত থানার একটি ছিনতাই মামলায় হাজত খাটে। ৩ মার্চ তিনি জামিনে বের হওয়ামাত্র এএসআই শাহ আলম পাশের একটি পোশাকের দোকানের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ৫ হাজার টাকা দাবি করেন। গত ২৫ ফেব্র“য়ারিও কারাগারের সামনের শীতল ফার্নিশার্স দোকানের মধ্যে এএসআই শাহ আলম একজন জামিনপ্রাপ্ত যুবকের কাছ থেকে পাঁচশ’ টাকা হাতিয়ে নেন।
এএসআই শাহ আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ যুগান্তরকে বলেন, একজন এএসআইয়ের কোনো ক্ষমতা নেই যে, সে গ্রেফতার করবে এবং গ্রেফতারের ভয় দেখাবে। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এখনও পাইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। সিটিএসবি কারাজোনের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মাহফুজুল হক যুগান্তরকে বলেন, এসবির যেসব কর্মকর্তা এখানে (কারাগারে) দায়িত্বে রয়েছেন, আমি আসার পর জেল গেট থেকে কাউকে ধরতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছি। তারা এ ধরনের কাজ করে না বলে দাবি করেন তিনি।
নিষিদ্ধ, তবুও : জানা যায়, জেল কোড অনুযায়ী বন্দিদের কাছে নগদ টাকা জমা রাখা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। অথচ অনেক বন্দি ভেতরে নগদ টাকা লেনদেন করে। প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে পাঠানো হচ্ছে বন্দিদের হাতে। এ জন্য ওই চক্র হাজারে কমিশন কেটে নেয় ২০০ টাকা। অর্থাৎ এক হাজার টাকা ভেতরে হয়ে যায় ৮০০ টাকা। গত ১০ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সরেজমিনে বন্দিদের স্বজন ও অন্তত ১০ কারারক্ষীর কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাইরে টাকা নেয়ার কাজটি করে থাকে কতিপয় কারারক্ষী ও কয়েকজন সিটিএসবি সদস্য। গেট দিয়ে ঢুকে কয়েকটি হাত হয়ে টাকাটা বন্দির কাছে পৌঁছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কারাগারের দর্শনার্র্থীদের প্রবেশ পথের উল্টো পাশে রয়েছে ‘জেলখানা ক্যান্টিন ঢাকা সেন্ট্রাল জেল’ নামে একটি জরাজীর্ণ দোকান ঘর। ওটি এখন ক্যান্টিন হিসেবে ব্যবহার হয় না। বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে সঙ্গে থাকা ব্যাগ, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মালামাল জমা রেখে যেতে হয় ওই দোকানে।
সিভিল পোশাকে কারারক্ষীরা সেখানকার দায়িত্ব পালন করেন। ভেতরে বন্দির কাছে অবৈধভাবে পাঠানোর টাকা বেশি লেনদেন ওখানেই হয়। তাছাড়া সিটিএসবির কয়েকজন সদস্য ও কারারক্ষী কারাগারের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকেও এ বাণিজ্য করে থাকেন। গত ১ মার্চ কারারক্ষী হারুন ও জহিরসহ তিনজন ছিলেন ওই দোকান ঘরে। তারা স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বন্দির কাছে পৌঁছে দেয়ার বাণিজ্য করে থাকেন। ওইদিন বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ৯ বন্দির স্বজনকে পৃথকভাবে তাদের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে মনিহার-৩ এর বন্দি নিজামের স্বজন সুরাইয়া বেগম জানান, নিজামের বাসা রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায়। সুরাইয়া চার হাজার টাকা পাঠায় তার কাছে। সুরাইয়াকে ওই কারারক্ষীদের একজন জানান, চার হাজার টাকায় ৩২শ’ টাকা পৌঁছবে নিজামের কাছে। ৯ জন বন্দির কাছে পৌঁছানোর জন্য মোট ২৮ হাজার টাকা লেনদেন চোখে পড়ে ওই সময়।
ক্যান্টিন নয়-লেনদেন কেন্দ্র : ‘জেলখানা ক্যান্টিন ঢাকা সেন্ট্রাল জেল’ নামে একটি জরাজীর্ণ দোকান ঘর। গত ৩ মার্চ গিয়েও হারুন ও জহিরসহ তিনজন কারারক্ষীকে সেখানে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। দর্শনার্থীদের মোবাইল ফোন ও জিনিসপত্র জমা রেখে প্রতিজনের কাছে ২০ টাকা করে আদায় তাদের বিশাল বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। কারা সূত্রে জানা যায়, গড়ে প্রতিদিন অন্তত সাতশ’ বন্দিকে স্বজনরা দেখতে আসেন। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, একজন বন্দির জন্য দুই বা তার বেশি ব্যক্তিও সাক্ষাৎ করতে আসেন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার স্বজন আসার খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যেকের হাতেই মোবাইল ফোন কিংবা প্রয়োজনীয় কিছু কাছে থাকেই। মোবাইল ফোনসহ জিনিসপত্র জমা রেখে ২০ টাকা হারে প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অবৈধভাবে। যা মাসে দাঁড়ায় ছয় লাখ টাকা।
এসব অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী বলেন, বন্দির কাছে নগদ টাকা থাকার কোনো নিয়ম নেই। পিসির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর নিয়ম আছে। তবে সেই টাকা বন্দির হাতে দেয়া হয় না। ওই টাকার বিনিময়ে সে কেনাকাটা করতে পারে। তাছাড়া বাইরে থেকে কারোর মাধ্যমে বন্দির কাছে নগদ টাকা পাঠানোর কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।