আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার আসামি সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর গত ১২ নভেম্বর ২০১৩ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে উঠে এসেছে ত্বকী হত্যার বিস্তারিত বিবরণ, নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে খুন করা হয়েছে বলে ভ্রমর জানায়।
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ভ্রমর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে। এর আগে গত ১১ নভেম্বর রাত দেড়টায় রূপগঞ্জ থেকে ভ্রমরকে গ্রেফতার করে র্যাব।
জবানবন্দী এবং খবরসূত্রে ত্বকী হত্যাকান্ডের কিছু তথ্য
ধরে নিয়ে আসা হয় ত্বকীকে
গত ৬ মার্চ বিকেলে শহরের কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের অফিস উইনার ফ্যাশনে যায়। অফিসের অভ্যর্থনা কক্ষে তখন বড় ভাই কাজল, শিপন ও জেকিসহ আরও কয়েকজন মিলে পুল খেলছিল। ভ্রমর অনেকক্ষণ ধরে পুল খেলা দেখে। এর পর ভ্রমর অফিসের সিসিটিভির ক্যামেরার মনিটরে দেখতে পায় রাজীব ও কালাম টয়োটা এক্স ফিল্ডার গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজীব, কালাম, মামুন, লিটন, ত্বকীকে নিয়ে আজমেরীর অফিসে আসে। রাজীব ও কালাম মিলে ত্বকীকে আজমেরীর রুমে নিয়ে যায়।
চলে নির্যাতন
এর দেড়ঘন্টা পর কাজল ভ্রমরকে বলে ‘চলো তো দেখি, কাকে নিয়ে এসেছে।’ এরপর ভ্রমর ও কাজল আজমেরীর পাশের রুমে যায়। এ সময় আজমেরীর রুম থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি, গালিগালাজের শব্দ আসছিল। রাত ১২টার দিকে আজমেরী তার রুমের থাই গ্লাসের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। দরজা খোলার পর ভ্রমর দেখে আজমেরীর রুমের ভেতর কালাম, লিটন, রাজীব ও মামুন দাঁড়িয়ে আছে এবং ত্বকীর লাশ চোখ বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে। দরজা খুলে বের হয়ে এসে আজমেরী ওসমান কাজলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সব শেষ। তোরা যেখানে পারিস লাশটা ফেলে আয়।’
শীতলক্ষ্যা নদীতে ত্বকীর লাশ
লিটন, রাজীব, কালাম ত্বকীর লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় আজমেরী ভ্রমরকেও তাদের সঙ্গে যেতে বলে। ভ্রমর যেতে রাজী না হলে আজমেরী শোকেস লক্ষ্য করে পিস্তল থেকে দুই রাউন্ড গুলি করে। এর পর রাজীব, কালাম, লিটন ও মামুন মিলে ত্বকীর লাশ আজমেরীর টয়োটা এক্স ফিল্ডার গাড়ির পেছনে তোলে। আজমেরীর ড্রাইভার জামশেদ গাড়িটি চালিয়ে চারারগোপ নিয়ে যায়। রাত দেড়টার দিকে চারারগোপে ১৬ তলা দেলোয়ার টাওয়ার বিপরীতে গাড়িটি থামে। গাড়ি থামার পর ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে থাকা ভ্রমর গাড়িটি পাহারা দিতে থাকে। রাজীব, লিটন, মামুন, কালাম ত্বকীর বস্তাবন্দী লাশ নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে যায়। ১৫/২০ মিনিট পরে তারা লাশটি শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে খালি হাতে ফিরে আসে। এর পর সবাই আবারও আজমেরীর অফিসে যায়। পরে সেখান থেকে যে যার মতো চলে যায়।
ত্বকীর লাশ যেভাবে পাওয়া যায়
৮ মার্চ শুক্রবার সকালে ত্বকীর লাশ তার বাসার কাছেই চারারগোপে শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায়। চারারগোপে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের স্থাপনায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালের তীরে ত্বকীর লাশ পড়ে ছিল। ত্বকীর বাঁ চোখ ছিল ফোলা, ডান চোখের পাশে ফোসকার মতো ফোলা, নিচে জমাট রক্তের দাগ, বুক ও গলায় আঘাতের চিহ্ন, শরীর কিছুটা ফোলা। সুরতহাল শেষে ত্বকীর লাশ লাশবাহী ব্যাগে করে রিকশাভ্যানে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থানায়, পরে জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়।
একজনের জবানবন্দী হতে আরেকজনের নাম
একটি মাদক মামলায় গ্রেফতারকৃত আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউসুফ হোসেন লিটন গত ৩০ জুলাই আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ত্বকী হত্যাকান্ড সম্পর্কে কিছু তথ্য জানান। উক্ত জবানবন্দীতে ভ্রমরের নাম আসে। এর পর থেকে র্যাব ভ্রমরকে খুঁজছিল।
আজমেরী ওসমানের অফিস থেকে আলামত উদ্ধার
লিটনের দেয়া জবানবন্দীর পরে র্যাব-১১-এর সদস্যরা গত ৭ আগস্ট শহরের কলেজ রোডে টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত আজমেরী ওসমানের অফিস ‘উইনার ফ্যাশনে’ অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, রক্তাক্ত গজারির লাঠি ও বস্তাবন্দী নাইলনের রশি উদ্ধার করে। দেয়ালে ও শোকেসে অসংখ্য গুলির আলামত পায়।
শোক এবং ক্ষোভে উত্তাল নারায়ণগঞ্জের মানুষ
ময়নাতদন্ত শেষে ত্বকীর লাশ নিয়ে শহরে মিছিল বের করেন সংস্কৃতিকর্মীরা। পরদিন তাঁরা শহরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকেন। ৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। নারায়ণগঞ্জের মানুষ স্মরণকালে এ রকম হরতাল দেখেনি। চায়ের টংয়ের দোকান পর্যন্ত খোলেনি। একটি রিকশাও চলেনি সেদিন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে নেমে আসে রাস্তায়। নারায়ণগঞ্জ সেদিন স্থবির হয়ে গিয়েছিল।
সন্দেহের তীর ওসমান পরিবারের দিকে
বকীর বাবা রফিউর রাব্বি ত্বকী হত্যাকান্ডের জন্য প্রথম থেকেই ওসমান পবিরারকে দায়ী করে আসছিল। নাসিম, সেলিম ও শামীম ওসমান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বরাবরই বলে আসছিল জামায়াত-শিবির ত্বকীকে খুন করেছে।
হত্যাকাণ্ডে যারা সম্পৃক্ত
এ মামলার তদন্তে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে র্যাব। তারা হলো- আজমেরী ওসমান, সুলতান শওকত ভ্রমর, ইউসুফ হোসেন লিটন, তায়েব উদ্দিন আহমেদ ওরফে জ্যাকি, কালাম শিকদার, কাজল, অপু, মামুন, রাজীব, শিপান ও জামশেদ। তাদের মধ্যে আজমেরী, রাজীব, মামুন, অপু, কাজল, শিপান ও জামশেদ পলাতক। এরই মধ্যে লিটন ও ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ভ্রমরের জবানবন্দিতে বলা হয়, ত্বকীকে আজমেরী ওসমানের শহরের আল্লামা ইকবাল রোডের টর্চার সেল উইনার ফ্যাশনে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
কেন এই হত্যাকান্ড?
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি মনে করেন, বিভিন্ন গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতেই ‘ওসমান পরিবার’ তার ছেলেকে হত্যা করেছে। এর কারণ, আমৃত্যু তাকে কষ্টের মধ্যে রাখা অথবা এসব আন্দোলন থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা।
নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থল চাষাঢ়ায় যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠেছে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির উদ্যোগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। এছাড়া রফিউর রাব্বি নারায়নগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, সেসব আন্দোলন অনেক সময় ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে গেছে।