আনডকুমেন্টেট বা বৈধ কাগজবিহীন অভিবাসীদের ফেরাতে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় বাংলাদেশের প্রতি নাখোশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ জন্য বাংলাদেশীদের ভিসা প্রক্রিয়ায় সাময়িক কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব করেছে ইউরোপীয় কমিশন। চলতি বছরের ১৫ জুলাই ইউরোপীয় কাউন্সিলের কাছে পাঠানো ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশ ছাড়াও ইরাক ও গাম্বিয়াকেও যুক্ত করা হয়েছে।
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৈধ কাগজবিহীন (আনডকুমেন্টেড) অভিবাসীদের ফেরত নেয়ার (রিঅ্যাডমিশন) ব্যাপারে দেশগুলোর সহাযোগিতা আরো জোরদার করতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে তারা।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বৈধ কাগজবিহীন অভিবাসীদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সাথে ইইউর স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের আরো দ্রুত সহযোগিতা চায় ইইউ। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদান-প্রদান ও জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিক থেকে আরো তৎপর পদক্ষেপের প্রত্যাশা তাদের।
ইইউ অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশ সরকার অনেক চিঠির জবাব দেয় না বা দিতে অনেক দেরি করে। ২০১৭ সালে চুক্তির পর তালিকা ও কাগজপত্র ম্যানুয়ালি বা সনাতন পদ্ধতিতে হস্তান্তর করা হতো। কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরে এই ব্যবস্থা ডিজিটাল করা হয়। ডিজিটাল হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ ‘আনডকুমেন্টেড’ বাংলাদেশীর তালিকা ও কাগজপত্র হস্তান্তর করে তারা। সেগুলো এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে জার্মানিতে। ইউরোপের এ দেশটিতে এমন ৮০০ বাংলাদেশী রয়েছেন, যোদের প্রয়োজনীয় বৈধ কাগজপত্র নেই। একইভাবে বাংলাদেশী রয়েছে ইটালি, গ্রিস ও মাল্টায়।
অভিবাসীর সংখ্যা
দুই কোটির বেশি অভিবাসী মানুষের বসবাস ইউরোপের ২৭টি দেশে। এ অঞ্চলের শ্রমবাজারে নিযুক্ত রয়েছেন ৮৮ লাখ। ২০১৯ সালে ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রথমবার রেসিডেন্স পারমিট বা বসবাসের অনুমতি পাওয়া তৃতীয় দেশের মানুষের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়রিতে ইইউ তাদের ভিসা নীতিতে পরিবর্তন আনে। এতে বলা হয়, যেসব দেশ রিঅ্যাডমিশন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে না তাদের ভিসা প্রক্রিয়া কড়াকড়ি করা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জার্মানিতে আনডকুমেন্টেড তালিকার মধ্যে বাংলাদেশ ১৫০ জনের সাক্ষাৎকার নেয়। এর মধ্যে মাত্র একজনকে ‘বাংলাদেশী আনডকুমেন্টেড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা জার্মানি ভালোভাবে নেয়নি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশীদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে ইইউ যদি ভিসার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করে তাহলে তা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কারণ এখন যারা ইউরোপের দেশে যাওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে তাদের ভিসা বন্ধ করতে পারে না। যার বৈধ ডকুমেন্ট আছে তাকে আটকানো হলে তার মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে। অথচ তারাই মানবাধিকারের প্রবক্তা। তারাই যদি এটা করে তাহলে তা হবে দুঃখজনক। কেউ আদালতে গেলে এর প্রতিকার পেতে পারেন।’
তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে শনিবার একটি বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু যারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আনডকুমেন্টেড আছেন তাদের মানবাধিকারের কী হবে?
তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্তে বিস্মিত নন। তার মতে, ২০১৬ সাল থেকেই তারা এ বিষয়ে কথা বলছে। এখন এই সিদ্ধান্তের ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের পোশাক শিল্পসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হতে পারে। যাদের প্রয়োজন তারা ভিসা নাও পেতে পারেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের দু’টি কাজ করা উচিত। প্রথমত, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। দ্বিতীয়ত, তারা যে তালিকা দেয় তা থেকে যাচাই বাছাই করে টোকেন হলেও কিছু লোককে ফেরত আনা। তিনি মনে করেন, অবৈধ অভিবাসীরা দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছেন।
এ দিকে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এখন সরকারি সফরে জার্মানিতে আছেন। তিনি বার্লিনে বাংলাদেশ-জার্মানি কৌশলগত সংলাপে বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সেখানে ভিসা কড়াকড়ি ও আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশী ইস্যু দু’টি বিষয় নিয়েও তিনি কথা বলবেন। অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনকে ফোন করলে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ফলে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত কতজন বৈধ কাগজবিহীন অভিবাসী ফেরত এসেছেন তা জানা যায়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই সংখ্যা হাতে গোনা হবে।
সম্প্রতি ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে গত ১২ বছরে ৬২ হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশী অবৈধভাবে ইউরোপে গেছেন। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গেছেন তিন হাজার ৩৩২জন। তাদের মধ্যে সর্বাধিক ৩৭ হাজার ১৯৮ জন ভূমধ্যসাগরের রুট ব্যবহার করেছে।
সূত্র : ডয়েচে ভেলে