থানাসহ বিভিন্ন স্থানে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাধারণ মানুষ ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে অকারণ দুর্ব্যবহার এবং অপেশাদার আচরণের অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে হরহামেশাই। যা জনমনে পুলিশ বাহিনীর নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিরও প্রধানতম কারণ। পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের এই তিক্ত অভিজ্ঞতায় বদল আনতে সম্প্রতি অন্যরকম এক উদ্যোগ নিয়েছেন চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (এসসপি) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম। গত এক মাস ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া মডেল থানা, রাউজান থানা, জেলা স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ সদস্যদেরকে প্রায়োগিক (প্র্যাকটিকাল) ক্লাসের মাধ্যমে ভালো ও উন্নত পেশাদার আচরণের শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত মে মাসের গোড়ার দিক হতে এই বিশেষ ক্লাসের কার্যক্রম শুরু করেন সার্কেল এএসপি। এ ক্লাস কার্যক্রম মূলত তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত- জ্ঞান অন্বেষা, ব্যবহারিক পাঠ এবং প্রয়োগ অভীক্ষা। প্রথম স্তর জ্ঞান অন্বেষা অনেকটাই শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক। এ সময় রীতিমতো বই, কাগজ- কলম, হোয়াইট বোর্ড, মার্কার ইত্যাদি ব্যবহার করে পুলিশ সদস্যদেরকে বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদসমূহ, মানবাধিকার, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জনগণের সঙ্গে পুলিশের আচরণ এবং পুলিশ-জনতা সম্পর্ক বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এছাড়া ভালো আচরণের গুরুত্ব এবং এর অনুপস্থিতির নেতিবাচক প্রভাবসম্পর্কেও জানানো হয়। পাঠদানের ধারাবাহিকতা নিশ্চিতে প্রণয়ন করা আছে সুনির্দিষ্ট সিলেবাসও।
দ্বিতীয় স্তরের কার্যক্রমে থানার পুলিশ সদস্যদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে নেওয়া হয়। কাউকে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য, আবার কাউকে আগত সেবাপ্রার্থী ও সাধারণ জনগণ সাজিয়ে তাদেরকে দেওয়া হয় ভালো আচরণের ব্যবহারিক পাঠ। একেবারে ডামি ডিউটি অফিসার ও নারী-শিশু ডেস্ক, সেন্ট্রি পোস্ট, রাস্তার চেকপোস্ট ইত্যাদি স্থাপন করে তাদের দৈনন্দিন কাজগুলো জনবান্ধব উপায়ে সমাধান করার বিষয় ব্যবহারিকভাবে শেখানো হয়। এছাড়াও থাকে যানবাহন ও গৃহতল্লাশি, পাসপোর্ট ও চাকরির ভেরিফিকেশন, রাত্রিকালীন ডিউটি, ট্রাফিক ডিউটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কীভাবে জনসাধারণের সঙ্গে আচরণ করতে হবে তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, থাকে গ্রুপ স্টাডির ব্যবস্থাও।
তৃতীয় এবং শেষ স্তর অর্জিত জ্ঞানের মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ অভীক্ষা। এক্ষেত্রে একেবারে নিয়মিত পুলিশি কার্যক্রম- যেমন রাস্তায় নেমে বাস্তব যানবাহন তল্লাশি, ট্রাফিক ডিউটি ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্রদের আচরণ মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধনি প্রদান করা হয়ে থাকে। সার্কেল এএসপির সরাসরি উপস্থিতি এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে একেকটি গ্রুপ সেই নিয়মিত পুলিশি কার্যক্রমে অংশ নেন, আর অন্যসব গ্রুপের সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সেই কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন এবং নোট নেন।
এক গ্রুপের আচরণ প্রদর্শনীর পর অন্য গ্রুপের সদস্যরা সেই আচরণের শুদ্ধতা ও প্রযোজ্যতা সম্পর্কে মতামত দেন। সবশেষে শিক্ষকের ভূমিকায় থাকা সার্কেল এএসপি নিজেও প্রতি গ্রুপের আচরণিক মান সম্পর্কে কথা বলেন এবং অনুরূপ পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য আরও উন্নততর আচরণ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেন। প্রতি থানায় সপ্তাহে কমপক্ষে এমন একটি ক্লাস নেওয়া হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে এএসপি আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, পুলিশ সদস্যদের আচরণে ইতিবাচক বদল আনয়ন এবং পেশাদারিত্বের মান বৃদ্ধির জন্য আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ ধারাবাহিক উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। আমি আমার আমার জায়গা থেকে এই লক্ষ্য অর্জনকে তরান্বিত করতে বাস্তব শিখনের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের আচরণগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্র্যাকটিকাল এপ্রোচের পরিকল্পনা করেছি। আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে এর ইতিবাচক ফল দেখা যাবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের চাকরিতে আসার আগে আমি বেশ কয়েক বছর বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে একটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলাম। শিক্ষকতার সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই পুলিশ সদস্যদের পাঠ নিচ্ছি।
শুধু পাঠদান এবং আচরণ সংশোধনই নয়, থানার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে জ্ঞান অর্জন এবং নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে এএসপির ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান থানায় স্থাপন করা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মিনি পাঠাগার’ শিরোনামের উন্মুক্ত লাইব্রেরি। পুলিশ সদস্যরাসহ থানায় আগত সাধারণ মানুষ এই লাইব্রেরি থেকে বই ধার নিতে এবং পড়ার পর সেটি ফেরত দিয়ে নতুন বই গ্রহণ করতে পারেন।
পুলিশ সদস্যদের জনগণের সঙ্গে ভালো আচরণের পাঠ দিচ্ছেন এএসপি আনোয়ার
পুলিশ সদস্যদের জনগণের সঙ্গে ভালো আচরণের পাঠ দিচ্ছেন এএসপি আনোয়ার
এ প্রসঙ্গে সার্কেল এএসপি শামীম বলেন, আমি মনে করি, পড়াশোনা এবং জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে মানুষের আচরণগত উৎকর্ষ সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এজন্য পাঠাভ্যাস তৈরির লক্ষ্যেই আমি আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত থানাগুলোতে এই লাইব্রেরি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি।
অভিনব এই প্র্যাকটিকাল ক্লাসের কার্যক্রমে খুশি সংশ্লিষ্ট থানাসমূহের পুলিশ সদস্যরাও। রাঙ্গুনিয়া থানার কনস্টেবল আরিফ বলেন, আমরা বেশিরভাগ পুলিশ কনস্টেবলই এসএসসি পাস করে চাকরি প্রবেশ করি। তাই সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে। আচরণের ক্লাস কররে আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বুঝতে পারছি। পাশাপাশি সংবিধান, মানবাধিকার ইত্যাদি সম্পর্কেও জানতে পারছি। একজন সিনিয়র অফিসার যখন এভাবে রাস্তাঘাটে নেমে আমাদেরকে হাতেকলমে শিখিয়ে দেন, বাস্তব ডিউটি করার সময় তা আমাদের আচরণকে একটু না একটু প্রভাবিত করবেই।