‘ইসরায়েল ব্যতীত বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে বৈধ’- বাংলাদেশের পাসপোর্টে লেখা এই বাক্যটি থেকে ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ কথাটি বাদ পড়ছে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্তেই নতুন ই পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলের প্রসঙ্গটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন লেখা থাকছে- এই পাসপোর্ট বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে বৈধ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, পাসপোর্টের ‘আন্তর্জাতিক মান’ রাখতে গিয়ে এই পরিবর্তন।
এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের কোনো বিষয় আছে কি না জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে শনিবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
বাংলাদেশি নাগরিকদের পাসপোর্টে এক সময় লেখা থাকত- ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সসেপ্ট ইসরায়েল, তাইওয়ান অ্যান্ড দ্য রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা’ কথাটি।
পরে দক্ষিণ আফ্রিকা ও তাইওয়ানের নামটি ওই নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে বাদ গেলেও ইসরায়েল থেকে যায়। দশককাল আগে হাতে লেখা পাসপোর্ট থেকে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) চালুর পরও আগের মতো প্রথম পৃষ্ঠায়ই লেখাটি ছিল।
এখন ই পাসপোর্টে এসেছে পরিবর্তন। তাতে লেখা হচ্ছে শুধু- ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’।
গাজায় সাম্প্রতিক ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মধ্যে এই পরিবর্তনটি আলোচনায় আসে।
আট দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে জিইয়ে থাকা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে।
ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ, ফলে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই। বিপরীতে ফিলিস্তিনকে দূতাবাস করতেও ঢাকায় জায়গা দেওয়া হয়েছে।
পাসপোর্টে পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আইয়ুব চৌধুরী বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে এটা হয়েছে।”
ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি দপ্তর।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “আন্তর্জাতিক মানের পাসপোর্টের স্ট্যান্ডার্ড রাখতে গিয়ে এটা করা হয়েছে।”
“বিশ্বের কোনো দেশ এ শব্দটি ব্যবহার করেনি। এমনকি আরব অঞ্চলের দেশগুলোও,” যুক্তি দেখান তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ই- পাসপোর্টে পরিবর্তন এলেও এমআরপিতে তা আগের মতোই রয়েছে।
তবে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এমআরপিতে পূর্বের কথাটি এখনও লেখা হচ্ছে। বাদ দেওয়ার বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া।”
পাসপোর্টের লেখায় পরিবর্তন হলেও তা পররাষ্ট্র নীতির কোনো পরিবর্তন নয় বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
“আমাদের ফরেন পলিসির কোনো পরিবর্তন হয়নি,” বলেন তিনি।
পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ শব্দবন্ধটি উঠে যাওয়ায় এখন বাংলাদেশ থেকে ইসরায়েল যাওয়ার পথ খুলল কি না- প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “পাসপোর্ট একজনের পরিচিতি। আর কোনো দেশে যেতে হলে তো ভিসা লাগে।”
বিষয়টির ব্যাখ্যায় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা-না থাকার কথা বলেন তিনি।
“কূটনৈতিক সম্পর্ক তো লাগবে। আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও অনেকেই অনেক দেশে ভিসা না পাওয়ার কারণে যেতে পারেন না।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, পার্সপোর্ট হল একটি ‘ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট’। কোনো দেশকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকার না করলেও কিছু ‘আসে যায় না’।
তার মতে, পাসপোর্টের বিষয়ে সিদ্ধান্তটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, এটা কূটনৈতিক নয় বলে এটায় গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।
এক সময় বাংলাদেশ থেকে তাইওয়ানে যাওয়ার ক্ষেত্রেও যে ইসরায়েলের মতো নিষেধ ছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশের অনেকে সেখানে ব্যবসা করছেন ।
“তাইওয়ানের রাজনৈতিক স্বীকৃতি আছে, কূটনৈতিক স্বীকৃতি নাই। তাইওয়ানের সাথে ইনফর্মালি ব্যবসা- বাণিজ্য হয়। যেটা চীনারাও করে। তাইওয়ানে যাওয়ার জন্য একটা কাগজ লাগে, সিঙ্গাপুরে তাদের কনস্যুলেট থেকে নিতে হয়, স্ট্যাম্প দেয় না। তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্ন এখানে আসে না, কারণ আমরা এটাকে চীনের অংশ বলে মনে করি।”
ঢাকায় তাইওয়ানের প্রতিনিধি অফিস খোলা হয়েছিল ২০০৪ সালে। তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ৩০ জুন তা বন্ধ করে দেয়।
সেই প্রসঙ্গ ধরে হুমায়ুন কবির বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য আমরা তাইওয়ানকে অফিস খোলার অনুমতি দিয়েছিলাম।… কিন্তু পরবর্তীতে চীনারা অসন্তুষ্ট হওয়ার পর সেটা আর হয়নি। আমরা তো তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলে মনে করি, স্বাধীন রাষ্ট্র নয় বা এটার স্বীকৃতি কোথাও নাই। ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র। দুটো ভিন্ন প্রকৃতির।”
তিনি বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে অনেক মুসলিম দেশের এখন সম্পর্ক হচ্ছে। তুরস্ক ও জর্ডানের সম্পর্ক আছে, আরব আমিরাতও করছে। এই ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত ও নেপালেরও কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে ইসরায়েলের সাথে।
“কাজেই এটা এখন নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর। আমরা ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে সোচ্চার।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য দুটো বিষয়ে বাংলাদেশ দৃঢ় সমর্থন দিয়ে আসছে। প্রথমত, ফিলিস্তিনিদের অধিকার, আর দ্বিতীয়ত জেরুজালেম হবে ফিলিস্তিনের রাজধানী।
“ইসরায়েলের দিক থেকে যেটা আসবে, জেরুজালেমকে তারা রাজধানী বলে।… ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক করতে গেলে তো আমাদেরকে ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেম মেনেই করতে হবে। সেটা আমরা করব কি না? সেটা রাজনৈতিকভাবে আমাদের জন্য করাটা ঠিক হবে কি না? এটা হল একটা।
“দ্বিতীয় বিষয় হল, ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, তাদেরকে উৎখাত, দুই রাষ্ট্র- ধারণা থেকে বের হয়ে আসা, এসব একটা অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করেছে। সে ধরনের সিচুয়েশনে আমাদের ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক করাটা নৈতিকভাবে ঠিক হবে কি না? এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
তৃতীয় একটি বিষয়ও যে এক্ষেত্রে বিবেচনায় আসবে, সে কথাও বলেন সাবেক এই কূটনীতিক।
“এটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এখানে ফিলিস্তিনের জন্য একটা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমর্থন আছে। সে জায়গায় আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত আরবদের বা ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কটা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা রাজনৈতিকভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্তটা নেব কি না? কারণ এখানে পলিটিক্যাল কস্ট ডমেস্টিক্যালি হতে পারে। এটা সরকার বিবেচনা করবে।”
তবে কূটনৈতিক সম্পর্কের এত হিসাব-নিকাশ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন না হুমায়ুন কবির।
“ইসরায়েলে যদি কোনো বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্য করে, আমরা কি তাদের ‘না’ করতে পারব? পাসপোর্ট যদি তারা একসেপ্ট করে, আমাদের দিক থেকে কোনো আপত্তি থাকার কারণ তো দেখি না। আমরা এখানে অফিসিয়ালি বারণ করব- কী করব না, সেটা ভিন্ন ইস্যু। পাসপোর্টে লেখা না লেখা দিয়ে আসলে কিন্তু সম্পর্কের জায়গাটা বিচার খুব একটা হয় না।
“এমন হতে পারে যে ইসরায়েলের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করার মতো লোকজন আছে। … তার মানে এটা না যে ইসরায়েলের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হল। সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছি- তা কিন্তু মিন করে না।”
সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের ভাষায়, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে ‘কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার’ দরকার হবে। আর পাসপোর্টে ওই পরিবর্তন আনার বিষয়টি একটি ‘প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত’।
“এটাতে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয় আছে বলে আমি মনে করি না।”