নূরিতা নূসরাত খন্দকার
মানব সভ্যতার ইতিহাসে সংগীত সব সময়ই সামাজিক নবজাগরণের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার বা মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে সংগীতের একটি বড় ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করেছি। হাজার বছর ধরে সৌদি আরবে নারী স্বাধীনতার দৃশ্য বিলীন থাকলেও বর্তমান সময়ে মক্কায় ঘটে যাওয়া একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্য দিয়ে সৌদি নারীদের স্বাধীনতার বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে শাসকশ্রেণি।
ঘটনাটির কেন্দ্রবিন্দু একটি র্যাপ গানের বাণী এবং একজন নারী র্যাপার। গানটির শিরোনাম ‘বিনতে মক্কা’; যা লিখেছেন এবং গেয়েছেন মক্কার নারী র্যাপার আইয়াসেল আল বিশি। মক্কার প্রথম নারী র্যাপার আইয়াসেল আল বিশি (পরিচিতি বেশি আইয়াসেল স্লে নামেই) মক্কা শহরের জন্য তার গর্ব সম্পর্কে মক্কার নারীদের প্রশংসা করে একটি মিউজিক ভিডিও পোস্ট করার জন্য তদন্তের মুখোমুখি হন গতবছর ফেব্রুয়ারিতে। ‘বিনতে মক্কা’র মানে মক্কার মেয়ে।
আইয়াসেল স্লে একজন ইরিত্রিয়ান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ নারী। ‘বিনতে মক্কা’ গানটির মিউজিক ভিডিওতে তাকে একটি ক্যাফেতে বাচ্চাদের সাথে নাচতে এবং মক্কার শারিরীকভাবে সক্ষম ও সুন্দর নারীদের সম্পর্কে ইংরেজি ও আরবি ভাষায় র্যাপ করতে দেখা গেছে। সৌদি আরবের হেজাজি অঞ্চলের শহর মক্কা।
ইসলামের সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মশহর এটি। আইয়াসেল তার গানে কাবাঘর, হজ ও মুসলিমদের তীর্থস্থান হিসেবে বিখ্যাত মক্কা নগরীর গৌরব তুলে ধরেননি। বরং এসব এড়িয়ে মক্কার নারী সম্পর্কে নতুন ভাবনা প্রকাশ করেছেন। তিনি গেয়েছেন- ‘মক্কা মেয়েদের সাথে আপনি প্রতিযোগিতা করতে পারবেন না’।
গানটি তিনি তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করেছিলেন গত বছর। কিন্তু গানটি আরব্য সংগীত ও সামাজিক ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করলেও তাতেই ঘটে যায় সামাজিক বিস্ফোরণ। গানের কথাগুলো হুলের মতন ফুটতে থাকে পুরুষতান্ত্রিক আরব্য সমাজের পুরুষ ও নারী উভয়ের মননেই। অনেকেই এ গানের বাণী সহ্য করতে পারেননি। কট্টর পুরুষতান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত সৌদি নারীরা। সেখানে অল্পকিছুদিন হলো কেবল নারীদের জন্য গাড়ি ড্রাইভসহ অন্যান্য কিছু বিষয় উন্মুক্ত করা হচ্ছে। সে সমাজে পবিত্র ধর্মীয় তীর্থের জয়গান না করে এমন নারী শক্তি জাগানিয়া গান কজনই বা পারবেন সহ্য করতে!
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়া মাত্রই মক্কা কর্তৃপক্ষ আইয়াসেল এবং ভিডিও প্রযোজনা দল উভয়েরই বিচার করা হবে বলে জানিয়েছিল। মক্কা কর্তৃপক্ষের মতে, “বিনতে মক্কা” আদতে মক্কার লোকদের রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যকে লঙ্ঘন করে এবং এর সম্মানিত জনগণের পরিচয় এবং ঐতিহ্যের বিরোধিতা করে। আর সেজন্য “বিনতে মক্কা” গানের ভিডিওতে আইয়াসেল স্লে-এর পাশে উপস্থিত থাকা নারীকেও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিল মক্কা কর্তৃপক্ষ।
বিবিসির সংবাদ অনুযায়ী, ভিডিওটি আইয়াসেলের ইউটিউব পৃষ্ঠা থেকে সরানো হয়েছে এবং তার পৃষ্ঠাটি স্থগিত করা হয়েছে। মানবাধিকারের পক্ষে এবং জনসাধারণ সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। কেবল সেটাই নয় এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সৌদি সমাজে নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোও তরান্বিত হয়েছে। আইয়াসেলের এ দুঃসাহসিক গান সৌদির বঞ্চিত নারী সমাজে খুলে দিয়েছে অধিকার আদায়ের রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।
তবে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিরিয়া ও সৌদি আরবের আঞ্চলিক কর্মকর্তা হাশেম হাশেম প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, “আইয়াসেলের ব্যাপারে সৌদি কর্তৃপক্ষ ‘হিপোক্র্যাট’দের মতো আচরণ করছে।তারা সংগীত উৎসব আয়োজন করে, তারা আন্তর্জাতিক তারকাদের নিয়ে আসে, কিন্তু আইয়াসেলের মতো স্থানীয় শিল্পীর ক্ষেত্রে এবং শিল্পের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নির্যাতনমূলক।”
সত্যিকার অর্থে, গানটি সৌদি আরবের প্রথম র্যাপ গান, যা সৌদি নারীদের সৌন্দর্যের প্রশংসা এবং মানসিক শক্তি বাড়ানোর লক্ষে তৈরি করা হয়েছে। অতীতে সৌদি সরকার মারিয়া কেরি, নিকি মিনাজ এবং বিটিএস ব্যান্ডকে তাদের রাজ্যে পারফর্ম করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
বিগত কয়েক বছর ধরে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের বেশকিছু সংস্কারমূলক উদ্যোগে দেশটিতে নারীদের ড্রাইভিং এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি নারীদের খেলাধুলার অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে। নারী স্বাধীনতার দিকে এসব ছোট ছোট পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও, সেখানে নারীরা এখনও তাদের মৌলিক অধিকার নিয়েই নানা ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হন।
আইয়াসেলের ভিডিও প্রত্যাখ্যান করে অনেকেই তাকে টুইটারে অপমান করে।
রক্ষণশীলদের কেউ কেউ লিখেছেন, “এ বিদেশিকে বিদেশে সাধারণ সৌদি আরব মহিলাদের এবং বিশেষত মক্কার মেয়েদের ব্যাপারে বলার অধিকার কে দিয়েছে?” বর্ণবাদী আক্রমণেরও শিকার হয়েছেন আইয়াসেল। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় একজন লিখেছেন, “মক্কা আফ্রিকা নয়”।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে অনেকেই দাবি করেছেন যে ভিডিওটির প্রতিক্রিয়াগুলো সৌদি আরবে আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের ইতিহাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। অনেকে টুইটারে এমনও লিখেছেন, “যদি এটি সৌদি আরবের কোনও উচ্চ বংশের অপেক্ষাকৃত ‘অভিজাত চামড়া’র অধিকারী কেউ গাইতেন, তাহলে এ মিউজিক ভিডিওকেই ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এর প্রগতি এবং সংস্কারের উদাহরণ হিসেবে টানা হত।”
তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে একটি জনপ্রিয় টুইট ছিল- “এটি বিরলতম একটি র্যাপ গান, যাতে কোনও অশ্লীলতা, অপমান, অশ্লীল দৃশ্য, নগ্নতা, হাশিশ বা ধূমপান, উচ্ছৃঙ্খলতা দেখানো হয়নি। এমনকি র্যাপার নিজেও হিজাব পরে আছেন।”
তবে হাশেম বলছেন, “সৌদি আরবে সব নারীই এখনো হুমকির মধ্যে রয়েছে।”
তিনি জানান, আইয়াসেলকে গ্রেপ্তার করে একদিনেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অথচ অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন কিছু নারী অধিকার কর্মী ২০১৮ থেকে নৃশংস পরিস্থিতিতে জেলে বন্দি আছেন। সৌদি নারী অধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে, যতক্ষণ না সরকার পুরুষ অভিভাবকত্ব ব্যবস্থা আমূল বদলানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেবে ততোক্ষণ সেখানকার সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটবে না। আইয়াসেল এবং তার মতো নির্মম ও নৃশংস বাঁধার মুখে যারা সৌদিতে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের জন্য পাশে মানবাধিকার রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থাকে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান হাশেম।
তবে আইয়াসেল আল বিশি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ভিডিওটি অনেকেই যেমন সমর্থন জানিয়েছেন। আবার অনেকেই এটার বিপক্ষেও ছিলেন। ভিডিওটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এ কারণে যে এতে অনুমতি ছাড়াই চিত্রগ্রহণ করা হয়েছিল। আমাকে এ বিষয়েই সৌদী আরবের প্রসিকিউটর জেনারেল জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। আমি জানতাম না যে আমাকে অনুমতি নিতে হবে”।
যদি আইয়াসেল আল বিশির এ কথা যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ তাকে গ্রেপ্তার না করে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আটক করা হয়েছিল মাত্র- তাহলে নতুন এক সৌদি আরব তৈরি হচ্ছে বলতেই হয়। যেখানে নারীরা গাড়ি ড্রাইভ করলেও মামলা ও আইনি ঝক্কি পোহাতে হতো সেখানে যে মিউজিক ভিডিওতে নারী র্যাপারের পাশে একজন পুরুষ ডান্সারের সাথে মেয়েশিশু টিশার্ট ও জিন্স পরিহিত অবস্থায় নৃত্যরত, সাথে আরও এক নারীর উপস্থিতি- সব মিলিয়ে মক্কার কৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য উপস্থিত- তাতে শিল্পী, কলাকুশলী ও ভিডিও নির্মাতা এতটা ছাড় পাবেন তা তো বিস্ময়ই সৃষ্টি করে বৈকি!
আইয়াসেল আল বিশি মক্কার প্রথম নারী, যিনি র্যাপ গানের মাধ্যমে মক্কার হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় অনুশাসনের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ধূমকেতুর মতন আছড়ে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছেন। গানে গানে মক্কার নারীশক্তিকে তিনি গর্বের সাথে উপস্থাপন করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। নারী আধিকার আদায়ের বিভিন্ন টুকরো টুকরো আন্দোলন ও ঘটনার মাঝে র্যাপার আইয়াসেল নামটি আরব্য দুনিয়া কাঁপিয়া দিয়েছে। বিনতে মক্কা সেই অর্থে নবজাগরণের গান।
প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে নিজ প্রতিভা, গুণ ও শক্তির বিনিময়ে বিশ্বের বুকে পথ চলার, তাদেরকে সেই পথচলা থেকে বঞ্চিত করে অবরুদ্ধ করে রাখা যাবে না- এ মিউজিক ভিডিওটি হয়তো তারই একটি বার্তা মাত্র।
আগামীতে আইয়াসেল নিয়ম মেনেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তার শ্রোতাদের জন্য আরও অনেক গান ও ভিডিও নিয়ে আসবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।