ব্রেকিং নিউজ
Home / অপরাধ জগৎ / রায়হান হত্যা: পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুকে গণপিটুনি সাজানোর চেষ্টা

রায়হান হত্যা: পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুকে গণপিটুনি সাজানোর চেষ্টা

 

সিলেট নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গত বছরের ১০ অক্টোবর রাতে এ রকম একটি ঘটনা সাজিয়ে পরদিন ১১ অক্টোবর প্রচার করা হয়। ঘটনার মূল হোতা পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকর্মীদের নিজ থেকেই ফোন করে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওই এলাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় কোনো গণপিটুনির চিত্র না পাওয়ায় প্রশ্ন ওঠে। পুলিশের গণপিটুনির গল্প থেকে সন্দেহ ও ক্ষোভ ছড়ায়। ২৪ ঘণ্টার মাথায় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে থানায় মামলা হয়।

সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ (৩৪) হত্যার পরবর্তী অবস্থা ছিল এ রকম। তবে মামলা হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টায়। হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর পালিয়ে ভারত পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মুখে তাঁকে ভারত থেকে কৌশলে দেশে ফিরিয়ে এনে গ্রেপ্তার করা হয়। রায়হান হত্যাকাণ্ড নিয়ে লুকোচুরির অবসান হয় তখন।

গণপিটুনির চিত্র ছিল না সিসি ক্যামেরায়
কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে আহত হয়ে কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল। তবে ওই এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্থাপন করা ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় এমন কোনো গণপিটুনির চিত্র পাওয়া যায়নি। কাস্টঘর এলাকা সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। এই এলাকার পুরোটাই সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। এসব ক্যামেরার মনিটর রয়েছে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের কার্যালয়ে। তিনি জানিয়েছিলেন, ১০ অক্টোবর রাত থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত কাস্টঘর এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজে কোনো গণপিটুনির দৃশ্য পাওয়া যায়নি।

রায়হানের পরিবারের ভাষ্য ছিল, রিকাবীবাজার এলাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করতেন। ১০ অক্টোবর রাতে বাসায় না ফেরায় তাঁকে খোঁজাখুঁজি করেন পরিবারের সদস্যরা। পরদিন ভোরে রায়হানের পরিবারের সদস্যদের কাছে বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে ফোনে জানানো হয়, রায়হান পুলিশ হেফাজতে আছেন। তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। তাঁরা এ সময় পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তবে গিয়ে জানতে পারেন, রায়হান মারা গেছেন। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে তাঁর লাশ শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা।

একটি ফোনের সূত্রে মামলা
বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে যে ফোনটি এসেছিল, সেই ফোনকলের সূত্র ধরে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। এই ঘটনায় ১২ অক্টোবর রাত আড়াইটার দিকে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় তিনি কাউকে আসামি করেননি। তবে মামলার এজাহারে যে মুঠোফোন থেকে পরিবারের কাছে কল এসেছিল, তার নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। ‘টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসো, আমাকে বাঁচাও’, রায়হানের এই আকুতি তুলে ধরা হয়।

রায়হানের বাসা সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নিহারিপাড়ায়। পরিবারে তাঁর স্ত্রী, দুই মাস বয়সী এক মেয়ে, মা ও চাচারা আছেন। রায়হানের পরিবারের ভাষ্য, রায়হান রিকাবীবাজার এলাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করতেন। ১০ অক্টোবর রাতে বাসায় না ফেরায় তাঁকে খোঁজাখুঁজি করেন পরিবারের সদস্যরা। পরদিন ভোরে রায়হানের পরিবারের সদস্যদের কাছে বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে ফোনে জানানো হয়, রায়হান পুলিশি হেফাজতে আছেন। তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। পরে জানতে পারেন, রায়হান মারা গেছেন। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে রায়হানের পরিবারকে জানানো হয়, নগরীর কাস্টঘর এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ধরা পড়ে গণপিটুনিতে রায়হান আহত হন। পরে তিনি মারা যান।

তবে রায়হানের পরিবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, কাস্টঘর এলাকায় কোনো ছিনতাই বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। তখন পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর অভিযোগ তোলা হয়। ওই এলাকার সিসি ক্যামেরাতেও গণপিটুনির কোনো চিত্র পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সোমবার বিকেলে ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী তিন পুলিশের জবানবন্দি

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলার তদন্ত শুরু করে। বরখাস্ত হওয়ার পর ১৩ অক্টোবর থেকে আকবরকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাকি তিনজন বরখাস্তের মধ্যে কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে ২০ অক্টোবর গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির সিসি ক্যামেরার চিত্র নষ্ট করা ও আকবরকে পালাতে সহায়তা করার দায়ে ‘টুইআইসি’ পদে থাকা এসআই হাসান উদ্দিনকে বরখাস্ত করা হয়।

ঘটনার দিন (১০ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত ফাঁড়িতে সেন্ট্রি পোস্টে কর্তব্যরত তিনজন কনস্টেবল শামীম মিয়া, সাইদুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে নির্যাতনের প্রমাণ মেলে। সাইদুর ও দেলোয়ারকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন আকবর। সত্য কথা বললে ‘বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।

পালিয়ে ধরা আকবর
১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেনসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। পরের দিন থেকে তিনি লাপাত্তা ছিলেন। আকবরের এই পলায়নে ক্ষুব্ধ হন মানুষ। নগরীর আখালিয়া এলাকা থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পর্যন্ত প্রতিদিনই প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সরব ছিল। রায়হানের মা ছালমা বেগমও সেই সব কর্মসূচিতে একাত্ম হন। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আমরণ অনশনও করেন তিনি। ১৩ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত পলাতক ছিলেন আকবর। ৯ নভেম্বর তাঁকে সিলেটের কানইঘাট উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ডোনা এলাকায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন আকবর। তাঁর ধরা পড়ার একাধিক ভিডিও ছাড়িয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এসব ভিডিওতে আকবরকে দেখা গেছে, খাসিয়াদের বেশে। ‘আমাকে বাঁচান…’ বলে আকুতিও প্রকাশ করেন।

যেভাবে ভারতে ছিলেন আকবর
পুলিশ সূত্র জানায়, ১৪ অক্টোবর আকবর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবশে করেন। সেখান থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আশ্রয় নেন আসামের শিলচরে। বাংলাদেশি পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে শিলচরের এক ব্যক্তিকে পাতানো ভাই বানিয়ে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেন। আকবর তখন বেশভূষা বদল করে নিজের নাম ‘কুমার দেব’ বলে পরিচয় দেন। এভাবে ১৮ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত বসবাস করেন।

আকবরকে ধরতে সিলেটের পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একটি দল ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় হয়। এরপর শিলচরে আকবরের আশ্রয়দাতাকে ১০ লাখ রুপি (১২ লাখ টাকা) দিয়ে আকবরকে ধরার বন্দোবস্ত পাকা করা হয়। পরদিন আশ্রয়দাতার লোকজনই ডোনা সীমান্তের ওপার থেকে কানাইঘাটে পাঠান। সেখান থেকে জেলা পুলিশের একটি দল আকবরকে গ্রেপ্তার করে।

‘অর্থের বিনিময়ে’ আকবরকে ফিরিয়ে আনার গুঞ্জন
আকবর পালিয়ে ভারতের শিলচরে টাকার বিনিময়ে পাতানো এক ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই আশ্রয়দাতাকে ১০ লাখ ভারতীয় রুপির বিনিময়ে আকবরকে বাংলাদেশ ফিরিয়ে এনে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ১৪ অক্টোবর থেকে টানা ২৬ দিনের চেষ্টায় এ কাজটি করতে সক্ষম হয়েছে বলে আকবরকে গ্রেপ্তারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র ওই সময় গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আকবর পালিয়ে ভারতে ছিলেন, বিষয়টি সবাই বলেছেন। কিন্তু আমরা তাঁকে সীমান্ত এলাকায় পেয়েছি এবং সেখান থেকে গ্রেপ্তার করেছি। কাজটি করতে আমাদের সহায়তা করেছেন সোর্সরা। আমি কানাইঘাটের স্থানীয় মানুষকেও আকবরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই।’

ভারতে আকবরের আশ্রয়দাতাকে ১০ লাখ ভারতীয় রুপির বিনিময়ে বাংলাদেশে এনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এ বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘দীর্ঘ নজরদারি ও আরও কিছুর বিনিময়ে আকবরকে ধরতে সক্ষম হওয়া গেছে। সীমান্ত এলাকাজুড়ে দীর্ঘদিনের নজরদারির পর আকবরকে আমরা শনাক্ত করতে সক্ষম হই। এরপর সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ অভ্যন্তর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।’ ভারতীয় আশ্রয়দাতাকে ১২ লাখ টাকা দেওয়া প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমাদের চেষ্টার সঙ্গে আরও কিছু বিনিময় হয়েছে।’ কী ‘বিনিময়’-এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পুলিশ সুপার।

‘রায়হানই যেন পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর শেষ নাম হয়’
রায়হান হত্যার পর সব আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তাঁর মা সালমা বেগম। বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চ কণ্ঠে কথাও বলেছেন। ২৩ অক্টোবর প্রথম আলোর অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার রায়হানই যেন পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর শেষ নাম হয়।’ অভিযোগপত্র দাখিলের পর সেই কথারই পুনরুল্লেখ করেন তিনি। সালমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জড়িত সব আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাহলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে। আমি মরে যাওয়ার আগে আসামিদের শাস্তি দেখে যেতে চাই, আর আমার ছেলেই যেন হয় পুলিশের হেফাজতে শেষ মৃত্যু।’
সূত্র : প্রথম আলোর সৌজন্যে