২০১৩ সালের শাপলাকাণ্ডের মামলা নিয়ে এখনও দৌড়ঝাঁপে আছেন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীপন্থী হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। এই ফাঁকে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা আহমদ শফীপন্থী আলেমরা। হেফাজতের ‘মূলধারা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে অংশটির কর্মতৎপরতা অনেকটাই চূড়ান্ত। পরিস্থিতি বুঝে অচিরেই নতুন কমিটির ঘোষণা দেবেন তারা। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত একাধিক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
হেফাজতের শফীপন্থী আলেম ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গতবছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় বাবুনগরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে আল্লামা শফীর অনুসারী, তার পুত্র মাওলানা আনাস মাদানীসহ বেশ কয়েকজন নেতার স্থান হয়নি। এরপরই এই অংশের নেতারা দফায়-দফায় বৈঠক করে নতুন কমিটি করার পক্ষে মত দেন। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা আহমদ শফীর অন্তত ছয় হাজার খলিফার সঙ্গে আলোচনা করেন উদ্যোক্তারা। এই আলোচনা নতুন গতি পাবে চলতি রমজান মাসে।
নতুন উদ্যোক্তাদের একাধিক নেতা জানান, নতুন প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী। তিনি এখন দুবাইতে। ৮-১০ দিনের মধ্যে দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তিনি এলে আবারও আহমদ শফীর খলিফাদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হবেন নতুন অংশের নেতারা।
হেফাজতের এই অংশের একজন দায়িত্বশীল আলেম বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফী জীবদ্দশায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ওই সময় তো হেফাজতের মামলাগুলো পেন্ডিং ছিল। এখন নতুন করে হেফাজতের সাম্প্রতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুরো কওমি মাদ্রাসা, ছাত্র-শিক্ষক সবাই বিপদে পড়েছে। এখান থেকে বের হতে হলে অবশ্যই হেফাজতকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক রাখতে হবে।’
সম্প্রতি হেফাজতের ২০১৩ সালের যে মামলাগুলো সক্রিয় করা হয়েছে, ওই সব মামলায় আহমদ শফীপন্থী আলেমদের অনেকেই আসামি। বিষয়টি নিয়ে এই অংশের নেতারা দুশ্চিন্তায় আছেন- এমন তথ্য জানালেও আদতে তাদের ওপর এমন কোনও চাপ নেই বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট অরাজকতার কারণে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসার যেসব নেতা সংগঠনটির দায়িত্বে আছেন, তাদের ব্যাংক একাউন্ট ও দেশের বাইরে থেকে এনজিওর মাধ্যমে আসা অর্থের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আলেমদের আয়ের ওপর কর বসানোর বিষয়টিও যুক্ত হবে, এমন আশ্বাস মিলেছে সংস্থাটির সূত্রে।
গত বছরের গত ১৮ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর মৃত্যুর পর যেসকল আলেম তার মৃত্যুর তদন্ত চেয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছিলেন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের এই নেতা। পরে গতবছরের ১৫ নভেম্বর বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের কমিটি হওয়ার পর মুফতি ওয়াক্কাসের দাবি ছিল, ‘সংগঠনের নতুন কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে হয়েছে।’
মুফতি ওয়াক্কাস প্রকাশ্যে আল্লামা শফীর মৃত্যুর তদন্ত, নতুন হেফাজতের বিষয়ে সোচ্চার থাকায় তাকে কেন্দ্রে রেখেই তৎপর ছিল শফীপন্থী আলেম ও উদ্যোক্তারা। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর এ বছরের ৩১ মার্চ মারা যান মুফতি ওয়াক্কাস। তার আকস্মিক মৃত্যুতে প্রক্রিয়াটি ধাক্কা খায় বলে মনে করেন একজন আলেম।
এ ছাড়া শফীপন্থী হেফাজতের উদ্যোগের অন্যতম নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহও করোনায় আক্রান্ত। শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) বিকালে বলেন, ‘আমি কিছু বলতে পারবো না। করোনায় আক্রান্ত আছি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’
হেফাজতের নতুন কমিটি, কারা থাকছে?
আল্লামা শফীপন্থী হেফাজতে ইসলামের অন্যতম উদ্যোক্তা মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহি বলেছেন, ‘এখন ওই (বাবুনগরীপন্থী) হেফাজতের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করছি। রমজান মাস চলছে। ঈদের পর আমরা আমাদের প্রক্রিয়াটি সামনে আনবো।’
কারা থাকবেন কমিটিতে, এমন প্রশ্নের জবাবে মঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফী জীবদ্দশায় যে ধাঁচে সব করেছেন, সেটাই থাকবে। হুজুর জীবিত থাকতেই কমিটি করেছেন, তার দেখানো পথেই আমরা কমিটি করবো।’
তা হলে তো আমির-মহাসচিব নির্বাচিত হয়েই আছেন? জবাবে রুহি বললেন, ‘না আমির হবেন কাউন্সিলের মধ্যে দিয়ে। আমরা কাউন্সিল করে আমির করবো।’
আহমদ শফীপন্থী একজন উদ্যোক্তা-আলেম জানান, সিনিয়র আলেমদের মধ্যে বেফাকের সাবেক মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মাওলানা নুরুল আমীন, মাওলানা সলিমুল্লাহ, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহি আছেন। এদের মধ্য থেকে কেউ আমির, কেউ মহাসচিব হতে পারেন। তবে, এক্ষেত্রে আহমদ শফীর বড়পুত্র মাওলানা ইউসূফের নামও তালিকায় আছে বলে দাবি আরেক আলেমের।