বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির, বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মকবুল আহমাদ ইন্তেকাল করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়েসহ অনেক আত্মীয়স্বজন রেখে গেছেন। বিকেলে তার লাশবাহী ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে জামায়াত নেতারা তার গ্রামের বাড়ি যান। বাদ মাগরিব ফেনীর নিজ গ্রামে নামাজে জানাজা শেষে মরহুমকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মকবুল আহমাদ ১৯৩৯ সালের ৮ আগস্ট ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ওমরাবাদ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় পূর্বচন্দ্রপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মকবুল আহমাদ স্থানীয় দাগনভূঞা কামাল আতাতুর্ক উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ বিদ্যালয় থেকেই অষ্টম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ফেনী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে জায়লস্কর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তিনি ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬২ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু এক বছর পর এ চাকরি ছেড়ে দেন এবং শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি নিজ এলাকার শরিষাদী উচ্চবিদ্যালয়ে চার বছর এবং পরে ফেনী সেন্ট্রাল উচ্চবিদ্যালয়ে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০ সাল থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংগ্রামের তৎকালীন ফেনী মহকুমার প্রথম নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সমাজসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। নিজ গ্রামের যুবকদের নিয়ে ১৯৬২ সালে ‘ওমরাবাদ পল্লী মঙ্গল সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দশ বছর পর্যন্ত এ সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ‘গজারিয়া হাফেজিয়া মাদরাসার’ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মকবুল আহমাদ ১৯৬২ সালে জামায়াতে যোগ দেন এবং ১৯৬৬ সালে রুকন হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফেনী শহর আমির, ১৯৬৮ সালে মহকুমা আমির এবং ১৯৭০ সালে নোয়াখালী জেলা আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ এবং ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মকবুল আহমাদ ১৯৭৯ সালে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৮৯ সালে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং ২০০৩ সালে নায়েবে আমির মনোনীত হন। ২০১০ সালে তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতার হলে মকবুল আহমাদ ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি জামায়াতে ইসলামীর তৃতীয় আমির নির্বাচিত হন এবং ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সফলতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন।
জামায়াতের শোক : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল এক বিবৃতিতে মকবুল আহমাদের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, সাবেক আমির, বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, শ্রদ্ধাভাজন মকবুল আহমাদের ইন্তেকালে আমরা একজন যোগ্য ও দরদি অভিভাবককে হারালাম। তারা আরো বলেন, মকবুল আহমাদ ছিলেন আল্লাহর পথে একজন আহ্বানকারী এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন-যাপন ও দাওয়াতি চরিত্র মানুষকে বিমোহিত করত। তিনি সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি তার এলাকায় অনেক সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এগুলোর মাধ্যমে তিনি সব সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন এবং যখনই কোথাও কোনো অসহায় মানুষের খবর পেতেন তখনই তাদের যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন।
জামায়াত নেতারা বলেন, দেশের বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি একজন যোগ্য অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। সংগঠনের দুর্দিনে তিনি দ্বীনের যে কঠিন জিম্মাদারি আঞ্জাম দিয়েছেন তা তাকে যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় করে রাখবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব এবং একজন উদার মনের রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের মানুষ তাকে সবসময় শ্রদ্ধার সাথে স্মারণ করবে।
বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে কায়মনোবাক্যে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহতায়ালা তার সব ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিন। তার নেক আমলগুলো কবুল করে তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে উচ্চ মর্যাদা দান করুন। তাকে সিদ্দিকীন সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন। আমরা তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, সুধী-শুভাকাক্সক্ষীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের উত্তম ধৈর্য ধারণ করার তাওফিক দান করুন।
বিএনপির শোক : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক শোকবার্তায় মকবুল আহমাদের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, মকবুল আহমাদ বর্তমান দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জন-অধিকার, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। বিএনপি মহাসচিব শোকবার্তায় মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
খেলাফত মজলিস : মকবুল আহমাদের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের। এক যৌথ শোক বাণীতে নেতৃদ্বয় বলেন, মকবুল আহমাদ একজন ভদ্র, ন¤্র ও অমায়িক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। একই সাথে তিনি একজন দৃঢ়চেতা ব্যক্তি ছিলেন। তার দলে এক কঠিন সময়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। নেতৃদ্বয় মরহুম মকবুল আহমাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে মহান আল্লাহর দরবারে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিবের জন্য দোয়া করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
কল্যাণ পার্টি : বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম মকবুল আহমাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করে বলেন, ২০ দলীয় জোট রাজনীতিক সুবাদে আমি তাকে একজন প্রাজ্ঞ, সহযোগিতাপ্রবণ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক হিসেবে পেয়েছি। জাতীয় রাজনীতিতে তার নেতৃত্ব এবং তার নেতৃত্বাধীন জামায়াতের ভূমিকা ইতিহাসের গঠনমূলক অংশ হয়ে থাকবে।
ইসলামী ঐক্যজোট : ২০ দলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাওলানা এম এ রকিব ও মহাসচিব অধ্যাপক আব্দুল করিম খান এক শোকবাণীতে মকবুল আহমাদের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
এ ছাড়াও শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা: মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব লায়ন ফারুক রহমান, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ উদ্দিন ও ভাইস চেয়ারম্যান এস এম ইউসুফ আলী। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট বদরুদ্দোজা সুজা, মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের, নির্বাহী সভাপতি আবদুল আজিজ হাওলাদার, স্থায়ী কমিটির সদস্য আতিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)-এর মহাসচিব অ্যাডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি প্রফেসর ড. এম কোরবান আলী ও জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক এ বি এম ফজলুল করিম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সিলেট বিভাগ, সিলেট মহানগরী, সিলেট জেলা দক্ষিণ ও উত্তরের নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাহউদ্দিন আইউবী ও সেক্রেটারি জেনারেল রাশেদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ছাত্রমিশন সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ মিলন, সিনিয়র সহসভাপতি নাসরুল্লাহ তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক মো: শরিফুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক কবি ইকবাল মাহমুদ।