’
প্রায় আট বছর আগে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে মোট ৮৩টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬১টি মামলার তদন্ত এখনো পুলিশ শেষ করতে পারেনি। গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে ঘিরে হেফাজতের বিক্ষোভ ও সহিংসতার পর নতুন করে পুরোনো মামলার তদন্ত শেষ করতে উদ্যোগী হয়েছে পুলিশ। আগের সব মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা দিয়েছে।
পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, হেফাজতের একটি অংশের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের বোঝাপড়ার কারণে এত দিন মামলাগুলোর তদন্ত চাপা পড়েছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের বোঝাপড়া হলেও তা আগের মতো ছিল না। এর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে বিক্ষোভ ও সহিংসতার কারণে নতুন টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক-ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে হঠাৎ আলোচনায় আসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ৬টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন সংগঠনের হাজারো কর্মী-সমর্থক। রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযানের মুখে তাঁরা শাপলা চত্বর ছাড়েন। অবরোধ ঘিরে মতিঝিল এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরদিন ৬ মেও চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এসব সংঘর্ষে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হন।
২০১৩ সালের তাণ্ডবের ঘটনায় শুধু রাজধানীতেই মামলা হয়েছে ৫৩টি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার ও লক্ষ্মীপুরে আরও ৩০টি মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদেরও আসামি করা হয়।
ঢাকার বিভিন্ন থানায় হেফাজতের বিরুদ্ধে করা ৫৩ মামলার মধ্যে মাত্র ৪টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৯ মামলার মধ্যে ৩৩টি থানা-পুলিশ ও ১৬টি মামলার তদন্ত করছে ডিবি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম প্রথম বলেন, পুরোনো মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা এসেছে। তখন তাণ্ডবে অংশ নেওয়া হেফাজতের অনেক নেতা-কর্মীকে ইতিমধ্যেই শনাক্ত করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যেই এসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ৩ হাজার ৪১৬ জনের নাম উল্লেখ করে ৮৩টি মামলায় মোট আসামি ৮৪ হাজার ৯৭৬ জন। হেফাজতের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীকে কোনো মামলায় আসামি করা হয়নি। তখন হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ (এখন আমির) কয়েকটি সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। এসব মামলার মধ্যে ২২টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগপত্র দেওয়া মামলাগুলোর মধ্যে শুধু বাগেরহাটের একটি মামলায় নিম্ন আদালত রায় দিয়েছেন। রায়ে সব আসামি খালাস পেয়েছেন।
# হেফাজতের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছিল ৮৩টি।
# এসব মামলায় মোট আসামি ৮৪ হাজার ৯৭৬ জন।
# মাত্র ২২টি মামলায় অভিযোগপত্র দিতে পেরেছে পুলিশ। একটির বিচার শেষ হয়েছে নিম্ন আদালতে।
সহিংসতায় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দাবি করেন, আগে যেসব মামলা হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়েও যে মামলা হচ্ছে, তা সবই মিথ্যা। পুরোনো মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছিল সরকার। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পুরোনো মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়ার আন্তরিকতা নেই বরং নতুন করে মামলা দিচ্ছে। মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁরা আগ্রহী।
নতুন করে সহিংসতা
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ এবং হরতালে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থানা, ভূমি অফিস, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সরকারি হিসাবে ১৭ জন নিহত হন। এর রেশ না কাটতেই ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের অবরুদ্ধ হওয়াকে কেন্দ্র করে আবারও হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
এসব সহিংস ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশে আরও ৭৪ টি মামলা হয়। এর মধ্যে ঢাকার মতিঝিল ও পল্টন থানায় ৪টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪৯টি, চট্টগ্রামে ৭টি, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ৬টি, সোনারগাঁয়ে ৬টি ও গাজীপুরে ২টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ৪৪ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়। পল্টন, মতিঝিল, সোনারগাঁ ও গাজীপুরে হওয়া মামলাগুলোতে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে যাঁরা রাজধানীতে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, হেফাজতের সেই নেতা-কর্মীদের অনেকেই এবারও বায়তুল মোকাররমের সামনে (২৬ মার্চ) সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিলেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাঁদের শনাক্ত করা হচ্ছে। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সমানতালে মামলার তদন্তও এগিয়ে চলছে। আর ২০১৩ সালের মামলাগুলোরও দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
সূত্র : প্রথম আলো