মর্তুজা হাসান সৈকত
নিম্নবিত্ত বা উচ্চবিত্ত নয়, গতবছরের লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণিটি ছিল মধ্যবিত্ত। ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পরিবার আছে৷ এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ৷ মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ এই তিন শ্রেণির মধ্যবিত্ত৷ সংখ্যায় এ শ্রেণিতে প্রায় আড়াই কোটি পরিবার আর দশ কোটি মানুষ আছে। চক্ষুলজ্জার কারণে এদের বেশিরভাগই মানুষের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চাইতে পারে না, পারে না ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে।
এক দফা লকডাউন শেষ হওয়ার পর ১৪ এপ্রিল থেকে এ বছরের দ্বিতীয় দফা লকডাউন শুরু হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এবার নাকি কড়াকড়ি করা হবে এবং অতি জরুরি সেবা ছাড়া সবই বন্ধ থাকবে।
যেহেতু মধ্যবিত্ত, ফলত এদের অবস্থান মাঝখানে। না পারে নিচে নামতে, না পারে উপরে উঠতে। করোনার মোকাবেলায় নিম্নবিত্তরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা পেলেও মধ্যবিত্তদের বড় একটি অংশই অসহায়। সীমিত আয়ে অনেক হিসেবে নিকেশ করে এদের জীবন যাপন করতে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মাত্র আট-দশদিন আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হলেই নেমে আসে চরম দুর্দশা। গতবারের মতো লকডাউনে এই শ্রেণিটি এবারও চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
সরকার, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠন সবারই লক্ষ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠী। গতবারের লকডাউনে এ জনগোষ্ঠীর সবাই কম বেশি সাহায্য পেয়েছে। এবারও করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ জনগোষ্ঠীর জন্য ‘মানবিক সহায়তা’ চালু করতে যাচ্ছে সরকার। লকডাউন ঘোষণার কারণে যেসব দরিদ্র মানুষ কর্মহীন হয়েছেন, তারাই এ সহায়তার আওতায় আসবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আসছে ঈদুল ফিতরে এ জনগোষ্ঠীর ১ কোটি ৯ হাজার মানুষকে নগদ অর্থ দেওয়া হবে। তাছাড়া, ৫০ লাখ পরিবারকে দেওয়া হবে খাদ্য সহায়তা। কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত, তারা দেয়ালে পিঠ ঠেকলেও হাত পাততে পারে না। তাদের জন্য সরকার কিংবা রাজনৈতিক সংগঠন কেউই আসলে নেই। এ শ্রেণির মানুষ নিজেদের পরিস্থিতি কাউকে জানাতেও পারে না, আবার সামাজিক মর্যাদার কারণে কারও কাছে হাতও পাততে পারে না৷ তদুপরি, নতুন করে লকডাউনের কারণে কর্মক্ষেত্রের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পুনরায় কাজ হারানো এই শ্রেণির অনেকেই এক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি মহা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। অনেকেরই চাকরি নেই। একটি অংশের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই। আরেকটি অংশের আবার চাকরি আছে কিন্তু বেতন কমে গেছে।
অন্যদিকে, রোজার মাস খুব কাছেই। তখনকার পরিস্থিতি কী হবে সেটা ভেবে এখনই আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে এই পরিবারগুলোতে। গতবারের লকডাউনে সরকারের পক্ষ থেকে নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, উচ্চবিত্তের জন্য ছিল শিল্পের প্রণোদনা। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসায়ীরা কিছুটা প্রণোদনা পেলেও অসহায় মধ্যবিত্তের জন্য মোটাদাগে তেমন কিছুই ছিল না। সেই পরিস্থিতি স্মরণে রাখলে বলা যায়, এবারের লকডাউনও ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে এই শ্রেণির মানুষের উপরে। ফলে এবার লকডাউন শুরুর আগেই ভাড়াটিয়া পরিষদ কাজ হারানো নিম্ন-মধ্যবিত্তের পরিবারের ভরণ-পোষণ, বাড়িভাড়া, ইউটিলিটি বিলসহ সকল দায়-দায়িত্ব সরকারকে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। গত ৩ এপ্রিল সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তারা এই দাবি জানিয়েছে।
কারণ, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই শ্রেণিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গতবছরের একটি জরিপে দেখা গেছে- করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হরিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম, তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তের ওপর করোনার অভিঘাত কতটা স্পষ্ট এই জরিপ সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
বিশ্বব্যাংক আর অর্থনীতিবিদেরা মধ্যবিত্তের একটা চেহারা দাঁড় করিয়েছেন আয় অথবা ক্রয় ক্ষমতা দিয়ে৷ কিন্তু গতবছরের লকডাউনে ঢাকা শহরে মধ্যবিত্ত চেনা গেছে অভাবের তাড়নায় ভাড়া বাসা ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার মধ্য দিয়ে৷ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এবারে তাদের কী অবস্থা? গতবছর তো পরিস্থিতি সামাল দিতে সঞ্চয় বলতে কিছু ছিল, এবার তো তাদের তাও নেই। ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এ শ্রেণির যাদের উপর দিয়ে ধকল সবচেয়ে বেশি গেছে তারা মূলত মধ্যবিত্তের প্রথম টায়ার। তবে করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় এবং নতুন করে লকডাউন আসায় বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের পরের টায়ারেও আঁচ লাগছে বেশ ভালোভাবেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্তদের এখনই রেশনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) অংশের সাধারণ সম্পাদক কমরেড ডা. এম এ সামাদ। গত ৪ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে এ দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, না হলে করোনা থেকে বাঁচলেও মানুষ না খেয়ে মারা যাবে।
ভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে বাংলাদেশে এর নির্মমতার শিকার বেশি হয়েছিল মূলত উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত মানুষেরা। কিন্তু এবার নতুন উপসর্গ নিয়ে যখন করোনার প্রকোপ হাজির হল, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আগের চেয়ে বহুগুণ- তখন ‘কপালপোড়া’ মধ্যবিত্তরাই এর শিকার হচ্ছেন বেশি! যদিও পর্যাপ্ত ডাটার ঘাটতির কারণে সুনির্দিষ্টভাবে এই ধরনের কথা বলা একটু কঠিনই। তবে সাদা চোখে দেখলে পরিস্থিতিকে এখন এমনই মনে হচ্ছে। কেবলমাত্র করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতি নয়, যে কোন সমস্যায় উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের তুলনায় বেশি ভুক্তভোগী হয় এই মধ্যবিত্তরাই। কারণ তাদের আয় সীমিত। এই সীমিত আয়ের কারণে জীবনের অনেক চাওয়া পাওয়াই তাদের সীমাবদ্ধ থাকে।
লেখা শেষ করছি, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর প্রতি সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠনকে মনোযোগী হওয়ার বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে। বিশেষ করে সরকারি উদ্যোগ না এলে এবারে এদের জীবনধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, এবারও সরকার কেবল নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকেই খাদ্য ও অর্থ সহায়তার আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে কেবলমাত্র নিম্নবিত্তদের নিয়ে ভাবলেই চলবে না, ত্রাণের লাইনে যে মধ্যবিত্ত দাঁড়াতে পারে না তাদের নিয়েও সরকারকে সমানভাবে ভাবতে হবে। তাদের মূল্যবোধ যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, তাদের মানসিকতা যাতে অপমানিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করে তাদের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।