২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে হরতাল দিয়ে শুরু হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলন। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে তাদের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের প্রতিবাদে আন্দোলন করেছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হলে ফুঁসে উঠে সারা দেশ। হরতাল ডেকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়। পুলিশের গুলিতে এই সময়ে প্রায় ১৫০ জন মানুষ নিহত হয় বলে খবর প্রকাশিত হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে এর প্রতিবাদে ৫ মার্চ সারা দেশে হরতাল ডাক দেন। এরপর বিএনপির সমাবেশে গুলির প্রতিবাদে ৭ মার্চ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান ও ১৫৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযানের সময় গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৮ ও ১৯ মার্চ, নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার প্রতিবাদে ২৭ ও ২৮ মার্চ হরতাল পালন করে ১৮ দলীয় জোট। দলের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দাবিতে ৯-১০ এপ্রিল, সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে ২৩-২৪ এপ্রিল হরতাল পালন করে বিএনপি। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সশস্ত্র হামলা ও গণহত্যার অভিযোগে ৮-৯ মে সারা দেশে হরতাল পালন করে ১৮ দল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং রাজপথে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের প্রতিবাদসহ পাঁচ ইস্যুতে ২৬ মে, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে ২৯ মে হরতাল পালন করে বিএনপি। সর্বশেষ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২৭-২৯ অক্টোবর টানা ৬০ ঘণ্টা, ৪ নভেম্বর থেকে টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল পালন করে ১৮ দল।
এসব আন্দোলনের মধ্যেই বিরোধী দলের সাথে কোনোরকম সমঝোতা ছাড়া ২৫ নভেম্বর দশম সংসদের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এর প্রতিবাদে ২৬ নভেম্বর থেকে পাঁচ দফায় ২১ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে ১৮ দল। শেষ পর্যায়ের এই আন্দোলনে সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির প্রায় সব শীর্ষ নেতাই ২০১৩ সালের মামলার আসামি। সর্বশেষ মামলা হয়েছে গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বাংলামোটরে পেট্রলবোমায় নিহত পুলিশ হত্যার অভিযোগে। এ বছর বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১০ হাজারেরও অধিক। এতে আসামি দুই লক্ষাধিক মানুষ। মামলা হয়েছে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়িতে অগ্নি সংযোগ, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে ধর্ষণের অভিযোগে। বিএনপির অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের তালিকাভুক্ত লক্ষ নেতাকর্মী আছেন মামলার তালিকায়।
সমঝোতার নাটক, ফোনালাপ : নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বরে সংলাপ-সমঝোতার নাটকও কম হয়নি। কথার নাটক, ভাষার নাটক ছাড়াও নভেম্বরে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূতের সম্মানে দুই দলের তিন দফা সংলাপ ছিল আলোচিত নাটক। এর আগে ব্যর্থ হয়েছিল জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের ফোনও। দুই নেত্রীর ফোনালাপও সমঝোতার বদলে উসকে দেয় বিরোধ বিদ্বেষ। সরকারি দল কোনোরকম ছাড় না দেয়ায় শেষ পর্যন্ত সংলাপের পথ বন্ধ হয়ে খুলে যায় টানা আন্দোলনের পথ।
মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি এবং অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া : প্রহসনের নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার ডাক দেয়া হলে বেসামাল হয়ে পড়ে সরকার। এ কর্মসূচি বানচালে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি ঢাকাও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তারা। ২০১৪ সালের প্রথম দিনে আজো খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ। আর আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শুরু হচ্ছে সারা দেশে অবরোধ। রাজনীতিতে তাই সঙ্কট, সহিংসতা আছে; সুখবর একদমই নেই।দেশ-বিদেশে আলোচিত শাহবাগ চত্বর:
সদ্যবিদায়ী বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ছিল রাজধানীর শাহবাগ চত্বর। একাত্তর সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন সাজা দেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। কিন্তু এ রায় প্রত্যাখ্যান করে সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে ওই দিন বিকেলেই কয়েকজন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগ মোড়ে আন্দোলন শুরু করে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় যা প্রায় বছরজুড়েই চলছিল। পরে শাহবাগের নাম রাখা হয় ‘প্রজন্ম চত্বর’। গড়ে উঠে গণজাগরণ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন। শুরুর দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বামপন্থী নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেন। পরে রাজধানীর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হয় সেখানে। ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা।
একপর্যায়ে তা নিয়ে বিতর্কও ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে। একশ্রেণীর মিডিয়ার বিরুদ্ধেও এতে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনের ফলে শাহবাগ থেকে মৎস্যভবন, রূপসী বাংলা হোটেল, কাঁটাবন মোড় পর্যন্ত এলাকা দীর্ঘ দিন বন্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবিরাম আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলন চালিয়ে যেতে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়। টাকাও সংগ্রহ করে গণজাগরণ মঞ্চ।
গভীর রাত পর্যন্ত চলা আন্দোলনে বেশকিছু সংখ্যক নারী লাঞ্ছনারও খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে আন্দোলন শুরুর পরপরই দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ আন্দোলনের খবর ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জনের দাবিতে শাহবাগে বিভিন্ন উসকানিমূলক স্লোগান দেয়া হয়।
যেভাবে শুরু গণজাগরণ মঞ্চ : গেল বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। কিন্তু ওই রায় প্রত্যাখ্যান করে ওই দিন বিকেলে ‘ব্লগার অ্যান্ড অ্যাক্টিভিস্ট’ নামের ব্যানারে কয়েকজন ব্লগার আন্দোলন শুরু করে। ডা. ইমরান এইচ সরকার নামে এক ব্যক্তি শুরুর দিকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। যিনি নিজেকে ব্লগার দাবি করেন। তবে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনের হাল ধরেন। শাহবাগে তৈরি করা হয় গণজাগরণ মঞ্চ।
বিশেষ করে জাতীয় সংসদে প্রধামনন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহবাগ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলে ছাত্রলীগের কবজায় চলে আসে আন্দোলন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেন। দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরে গণজাগরণ মঞ্চের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফলে দেশব্যাপী এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলন চলাকালে মিরপুরে নিহত হন আহমেদ রাজীব হায়দার নামে এক ব্লগার। এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরকে অভিযুক্ত করলেও তা প্রমাণ করতে পারেনি প্রশাসন। এ ছাড়া আন্দোলনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক পুলিশ সদস্যকেও দুর্বৃত্তরা খুন করে। যার লাশ পাওয়া গিয়েছিল মতিঝিলে।
গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম : ৬ দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবিতে বিভাগীয় সমাবেশ করে গণজাগরণ মঞ্চ। শাহবাগে তাঁবু খাটিয়ে এবং স্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে চলে টানা আন্দোলন। পালাক্রমে চলতে থাকে কর্মসূচি। নানা ধরনের স্লেøাগান দিয়ে মাতিয়ে তোলা হয় শাহবাগ এলাকা। স্লোগান দিতে গিয়ে সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী লাকি আক্তার স্লোগানকন্যা হিসেবে নতুনভাবে আবির্ভূত হন। রাজধানীর মিরপুর, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মতিঝিল, বাহাদুর শাহ পার্ক ও যাত্রাবাড়ীতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াত সংশ্লিষ্ট ৩৬টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে লিফলেট বিতরণ করা হয় শাহবাগ সমাবেশে। বিশালাকৃতির জাতীয় পতাকা ও ব্যানার টানানো হয় গণজাগরণ মঞ্চের চার দিকে।
সব যুদ্ধপরাধীর ফাঁসি ও অন্য দাবিতে সরকারের কাছে ছয় দফা দাবি পেশ করে গণজাগরণ মঞ্চ। একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে সরকার। এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারাগারে আটক থাকা বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন নেতার রায় ঘোষণা করা হয়। সব রায় কার্যকরের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে গণজাগরণ মঞ্চ।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের সহায়তা : গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন মহল থেকে অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সেখানে রাখা হয় ভ্রাম্যমাণ টয়লেট, পানির ট্যাংক, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগ, সিসি টিভি ইত্যাদি। শাহবাগ মোড়ের চার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত টানানো হয় বেশ কয়েকটি মাইক।
এ ছাড়া পুলিশ ও র্যাব শাহবাগকে কেন্দ্র করে আশপাশে গড়ে তোলে নিরাপত্তা বলয়। প্রবেশ পথগুলোতে বসানো হয় বেশ কয়েকটি আর্চওয়ে। আগন্তুকদের দেহ তল্লাশি করা হয়।
রাজনৈতিক পটভূমি : গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে সংহতি জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তসহ বিভিন্ন নেতা ছুটে আসেন শাহবাগে। আন্দোলনকে তারা সমর্থন জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন। এর আগে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমারও মন চায়, আমিও শাহবাগের তরুণদের আন্দোলনে যোগ দিই।’ এরপরই আন্দোলন আরো জোরদার হয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার্থীদেরও নিয়ে আসা হয় আন্দোলনে। এভাবে প্রায় বছরজুড়েই থেমে থেমে চলছিল শাহবাগ মোড়ে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন।
ও দিকে বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মানের হয়নি বলে বরাবরই অভিযোগ করা হয়। তাই এ বিচারকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে স্বচ্ছভাবে করার দাবি জানায় দলটি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলে, ‘শাহবাগে যারা আন্দোলন করছে তারা নষ্ট তরুণ এবং বেশির ভাগই নাস্তিক।’ এরপরই আন্দোলনকারীদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এবং বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনও আন্দোলনকারীদের নাস্তিক বলে অভিহিত করে।
তবে আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন খবর প্রকাশ করায় আমাদেশ পত্রিকা বন্ধ ও এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।
সর্বশেষ: ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করায় উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায় কার্যকরের দাবিতে শাহবাগে আবারো জড়ো হন ব্লগার ও বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধপরাধীদের রায় কার্যকরের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ৫ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ। এরপর তা কার্যকর দাবিতে ফের শাহবাগে আন্দোলন শুরু হয়। অতঃপর ১২ ডিসেম্বর রায় কার্যকর হলে আনন্দ মিছিল করে গণজাগরণ মঞ্চ। এখনো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে গণজাগরণ মঞ্চ।
হেফাজতের উত্থান ‘শাপলা ট্র্যাজেডি’ অতঃপর…
‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের উত্থান বিদায়ী ২০১৩ সালের শীর্ষ আলোচিত ঘটনার একটি।
নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের শীর্ষ ও বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন অরাজনৈতিক সংগঠনটির নতুনরূপে আকস্মিক উত্থান ঘটে বছরের শুরুতে, যা পরে সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনসহ বহুল আলোচিত ১৩ দফা দাবির আন্দোলনে রূপ নেয়। দলমত নির্বিশেষে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের সমর্থনে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে সংগঠনটি। এই সংগঠনের ব্যাপক জনসম্পৃক্ত আন্দোলন সরকারকে অনেকটা বিচলিত করে তোলে। একপর্যায়ে সরকার ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতের লাখো নেতাকর্মীকে অবস্থান থেকে সরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে, যাতে বহু লোক হতাহত হয়। যাকে অনেকেই ‘শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। হেফাজত ওই ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যায়িত করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে।
হেফাজতের ব্যানারে ৬ এপ্রিল রাজধানীতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ হয়। আবার ৫ মে রাতে এই সংগঠনেরই একই ধরনের একটি মহাসমাবেশ পণ্ড করার জন্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভিযানটি পরিচালিত হয় শাপলা চত্বরে। এতে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যানের পাশাপাশি প্রায় দেড় লাখ রাউন্ড গুলি ব্যবহারের তথ্য আসে সংবাদমাধ্যমে।
হেফাজতের উত্থান হেফাজতকে ঘিরে নানা ঘটনা দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে গভীর প্রভাব ফেলে। পরে দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
হেফাজতের উত্থান যেভাবে : ২০১০ সালের ১৯ জানুযারি হেজাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। চট্টগ্রামের কওমি মাদরাসাগুলোর ছাত্র- শিক্ষকদের নিয়ে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে প্রধান করে এটির যাত্রা শুরু হয়। সরকার ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ ঘোষণা করলে তাকে ধর্মবিরোধী আখ্যায়িত করে এর প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা করে সংগঠনটি। তারপর একে একে যুক্ত হয়, ২০১১ সালে সরকারঘোষিত নারী নীতি, পর্দার ব্যাপারে হাইকোর্টের একটি রায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও মহল কর্তৃক ইসলাম, মহানবী (স:)-কে নিয়ে অবমাননাকর উক্তি, ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি বাদ দেয়া, বিসমিল্লাহকে অনুবাদ করে তা সংবিধানে সংযোজনসহ নানা ধর্মীয় ইস্যু। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সংগঠনটির কার্যক্রম অনেকটা চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বিদায়ী ২০১৩ সালে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে হেফাজতের নতুনরূপে বিস্ময়কর উত্থান ঘটে।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে শাহবাগে অনলাইন ব্লগারদের নেতৃত্বে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ এর অভ্যুদয় ঘটে। আর অনেকটা গণজাগরণ মঞ্চের ‘ক্রিয়ার বিপরীত ক্রিয়া’র মতোই কিছুদিন যেতে না যেতেই আকস্মিকভাবে হেফাজতে ইসলামেরও নতুন রূপে উত্থান ঘটে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়ার পর তা প্রত্যাখ্যান করে তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ সৃষ্টি হয়। তখন সবার দৃষ্টি ছিল সেই শাহবাগে। সেখানে রাতদিন ফাঁসির দাবিতে অবস্থান চলতে থাকে। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহবাগের আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ব্লগারদের একজন আহমেদ রাজিব হায়দার শোভন রাজধানীর মিরপুরে নিজ বাসার সামনে গুপ্ত হামলায় খুন হলে নতুন পরিস্থিতি হয়। এতে এক দিকে শাহবাগের আন্দোলনকারীরা যেমন আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে অন্য দিকে নিহত রাজিব ‘থাবা বাবা’ নামে ব্লগে ইসলাম ও মহানবীকে কটুক্তি করে লেখালেখি করেছেন এবং তিনি একজন স্বীকৃত নাস্তিক- এমন খবর প্রচার ও প্রকাশিত হতে থাকে। একই সাথে শাহবাগের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও জড়িতদের অনেকে নাস্তিক এবং তারা ব্লগে ফেসবুকে মহানবী (স:), ইসলাম, কুরআনকে অবমাননা করে মারাত্মক কটূক্তি করেছেনÑ এমন খবর পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পরই মূলত পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়া শুরু করে। প্রথমে ওলামা-মাশায়েখদের ব্যানারে এবং বিভিন্ন ইসলামি দলের অংশগ্রহণে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে এর নেতৃত্বে চলে আসে হেফাজতে ইসলাম। কয়েকটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভে নামে বিভিন্ন সংগঠন। এরপর হেফাজতসহ বিভিন্ন ইসলামি দল সম্মিলিতভাবে ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ কর্মসূচী দেয়। ওইদিন ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে বিশাল মিছিল বের হলে পুলিশ মিছিলে হামলা চালায় এতে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঢাকার বাইরে গাইবান্ধা, সিলেট ও ঝিনাদহে পুলিশের গুলিতে চারজন মুসল্লি নিহত হন। এরপর সরকার বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিতে থাকে। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট বন্ধ করে দিয়ে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। এরই মধ্যে জামায়াতের নায়েবে আমির প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। এতে সারা দেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। তিন দিনে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। দেশ অনেকটা অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়।
৯ মার্চ হাটহাজারিতে সারাদেশের আলেমদের নিয়ে সম্মেলন করেন হেফাজত আমির আল্লামা শফী। এতে কওমি মাদরাসা ভিত্তিক ইসলামী দল ও সংগঠনসহ সারা দেশের শীর্ষ স্থানীয় কওমি আলেমরা যোগ দেন। ওই সম্মেলনেই ১৩ দফা দাবি চূড়ান্ত করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।একই দাবিতে সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, মহানবীর প্রতি কটূক্তিকারী বিশেষ করে ব্লগারদের গ্রেফতার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন পাসের দাবিও অন্তর্ভূক্ত হয়। এ ছাড়া শাহবাগে আন্দোলনের নামে ইসলামের অবমাননা এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা হচ্ছে অভিযোগ করে তা বন্ধের দাবিও স্থান পায়। এসব দাবি আদায়ে বিক্ষোভ, শানে রেসালত সম্মেলন ছাড়াও ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ ঘোষণা করা হয় ওলামা সম্মেলন থেকে।
দেশের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ : ১৩ দফা দাবি আদায়ে হেফাজতের ঢাকায় লংমার্চ দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। লংমার্চ শেষে শাপলা চত্বরে সমাবেশেরও ডাক দেয়া হয়। ৬ এপ্রিলের লংমার্চে বাধা সত্ত্বে¡ও শাপলা চত্বর জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে লোকের সংখ্যা ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়। এই সমাবেশকে প্রবীন অনেকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও মহাজোটভুক্ত জাতীয়পার্টিসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন লংমার্চ ও সমাবেশের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে আগতদের পানি পান, খাবার সরবরাহসহ নানাভাবে অভ্যুর্থনা জানায়। মহাসমাবেশ থেকে দাবি আদায়ের আলটিমেটাম দিয়ে আবারো ৫ মে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা অবরোধ ও ‘শাপলা ট্র্যাজেডি’ : এবার ঢাকা অবরোধ নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। সরকার এবার অনেকটা প্রকাশ্যেই অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে থাকে। সরকার নানাভাবে অবরোধ প্রত্যাহারে হেফাজত আমিরের কাছে দফায় দফায় লোক পাঠায়। এমনকি দাবি মেনে নেয়ার মৌখিক আশ্বাসও দিতে থাকে। একপর্যায়ে সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। সরকার অবরোধ প্রত্যাহারে নানা চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ৪ মে সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবরোধকে সামনে রেখে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি হেফাজতের দাবিগুলো মানা সম্ভব নয় বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেও রানা প্লাজা ধসের ঘটনার কথা বিবেচনা করে অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
৫ মে ভোররাত থেকে ঢাকার প্রবেশ পথের ৯টি পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে হেফাজত ঢাকা অবরোধ করে ফেলে। দুপুরের দিকে হঠাৎ করে সরকার অবরোধকারীদের বায়তুল মোকাররম নয়, শাপলা চত্বরের সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। ফলে অবরোধকারীরা শাপলা চত্বরমুখো হয়; কিন্তু শাপলা চত্বরে প্রবেশের মুখেই গুলিস্তান এলাকায় হেফাজতকর্মী ও সরকারি দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে সরকার সমর্থকদের সাথে যুক্ত হয় পুলিশও। এই সংঘর্ষ আশপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে এক দিকে সংঘর্ষ চলতে থাকে অন্য দিকে শাপলা চত্বরে চার দিক থেকে লাখো হেফাজতকর্মী সমর্থক এসে অবস্থান নেন। সন্ধ্যার আগেই বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী পল্টন, গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় সরকারি দল সমর্থকদের হামলা ও পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই খবরে শাপলা চত্বরে উত্তেজনা দেখা দেয়। সরকারকে গুলি থামানোর আহ্বান জানানো হয়; কিন্তু ওই এলাকায় সংঘর্ষ চলতেই থাকে। একপর্যায়ে হেফাজত শাপলা চত্বরে রাতেও অবস্থানের ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করে। হেফাজতের অবস্থানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিরোধী দলও। অন্য দিকে সরকার সন্ধ্যার পর থেকে ভিন্ন রকমের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। গভীর রাতে আইনশফঙ্খলা বাহিনী চতুর্দিক থেকে অবস্থান স্থলের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণে হেফাজতকে সরানোর অভিযান শুরু করে। ভোরের আলো ফোটার আগেই শাপলা চত্বর বিধস্ত এলাকায় পরিণত হয়। বেশ কিছু লাশ পড়ে থাকতে এবং তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়। পর দিন নারায়ণগঞ্জ, হাটহাজারীসহ কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে একজন বিজিবি সদস্যসহ আরো বেশ কয়েকজন নিহত হয়। এ দিকে ওই রাতেই সরকার দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। ৬ মে দুপুরে হেফাজত আমিরকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেয় সরকার। বিকেলে মহাসচিব আল্লামা বাবুনগরীকে গ্রেফতার করা হয়।
রাতের অভিযানে হতাহত নিয়ে নানা কথা বের হয়। নিহতদের লাশ ট্রাক ভর্তি করে রাতেই সরিয়ে ফেলার অভিযোগ ওঠে। মৃতের সংখ্যা তিন থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত হতে পারেÑ এমন নানা কথা মানুষের মুখে মুখে প্রচার হতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে পরে অভিযানে কোনো লোক মারা যায়নি বলে দাবি করা হয়। পুলিশ কোনো মারণাস্ত্র বা গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগে নিহতদের লাশের দৃশ্য এবং র্যাব পুলিশের গুলি চালানোর দৃশ্য, গুলিতে আহত হয়ে কাতরানোর দৃশ্য সংবলিত বিভিন্ন ভিডিও কিপ দেখতে পাওয়া যায়। আলজাজিরাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বহু হতাহত হওয়ার খবর প্রচারিত হয়। সরকারি প্রেস নোটেও অভিযানে কেউ নিহত হওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়। ওই দিনের ঘটনায় বায়তুল মোকাররম এলাকায় কুরআন শরিফ পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে হেফাজতকে দায়ী করা হয়। হেফাজত এ জন্য সরকার দল সমর্থকদের দায়ী করে ঘটনার তদন্ত দাবি করে। এরপর হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা করা হয়। হেফাজত ঘটনার প্রতিবাদে পরে এক দিনের হরতাল দিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়। পরে হেফাজতের কর্মসূচি দোয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পর গত ১০ জুন অধিকার এ বিষয়ে একটি রিপোর্টে ৫ মের ঘটনায় ৬১ জন নিহত হওয়ার তথ্য জানায়। এই রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ১০ আগস্ট রাতে অধিকারের সম্পাদককে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে তথ্য অধিকার আইনে মামলা করা হয়। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, শাপলা চত্বরে একজনও মারা যায়নি, হেফাজত কর্মীরা গায়ে রঙ মেখে লাশ হওয়ার ভান করে শুয়েছিল। পুলিশ টান দেয়ার পর উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেছে। একই ধরনের বক্তব্য দিতে থাকেন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। তবে গত ৯ নভেম্বর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের নিজস্ব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে ৫ মে শাপলা চত্বরে ৩৯ জন নিহত হয় বলে জানায়। শাপলা চত্বরের হতাহতদের বিষয়ে হেফাজতের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান জানানো হয়নি। পরিসংখ্যান তৈরিতে নানা সমস্যা হচ্ছে দাবি করে নেতারা কাজ চলছে বলে জানান।
শাপলা চত্বরের ঘটনার পর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ ঘটনার পর দেশে দুই দফায় অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, খুলনা ও গাজীপুরে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
সরকারের তৎপরতা ও ঘরোয়া কর্মসূচি : চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফলের পর সরকার হেফাজতকে নিয়ে অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আগে নানাভাবে তাদের আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও সিটি নির্বাচনের পর থেকে হেফাজতবিরোধী সরাসরি অবস্থান নিতে শুরু করে সরকার। হেফাজত নেতাদের বিভিন্নভাবে চাপে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো হয়। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং সরকার সমর্থক ইসলামি দল ও আলেমদেরকে কাজে লাগাতে থাকে। এরই মধ্যে হেফাজত আমিরের কথিত একটি ভিডিও কিপ সরকার দল সমর্থিত কয়েকটি টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হয়। ওই কিপে হেফাজত আমিরের কিছু বক্তব্যকে নারীর বিরুদ্ধে চরম অবমাননাকর এবং নারী শিক্ষাবিরোধী বলে দাবি করে ব্যাপক প্রচারণা চলতে থাকে। হেফাজতের পক্ষ থেকে ভিডিওটিকে মিডিয়ার ফটোশপের কারসাজি হতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়। এই অবস্থায় নানা বক্তব্য-বিবৃতি এবং ঘরোয়া কর্মসূচির মধ্যেই হেফাজতের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ থাকে। কর্মসূচি ঘোষণা করার পর প্রত্যাহার করে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে হেফাজত সব প্রস্তুতি নিলেও সরকার অনুমতি দেয়নি জানিয়ে আগের দিন সেটি স্থগিত করার ঘোষণা আসে হেফাজতের পক্ষ থেকে। গত বুধবার আবারো ওলামা সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়ে হেফাজত শুক্রবার দোয়া দিবস পালন করে।
এরশাদকে ‘বদদোয়া’ : নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে গত ১৭ নভেম্বর মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হেফাজত আমির আল্লামা শফীর সাথে দেখা করে আসেন। তিনি হেফাজতকে নিয়ে একটি জোট গঠনের চেষ্টার অংশ হিসেবে সেখানে যান মর্মে জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি হলে দোয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন বলে এরশাদ নিজেই জানান। পর দিন এরশাদ আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন। ওই দিনই এক বিবৃতিতে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এরশাদ দোয়া নয়, বদদোয়া নিয়ে গেছেন।’
সরকারি প্রতিনিধিদলের বৈঠক ও খোলা চিঠি : চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের সাথে হেফাজত সমর্থক অনেক রাজনৈতিক দল যুক্ত থাকলেও হেফাজতের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো সমর্থন ঘোষণা করা হয়নি। এরই মধ্যে গত ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিবের নেতৃত্বে সরকারের ঊর্ধ্বতন একটি প্রতিনিধি দল হেফাজত আমির আল্লামা শফীর সাথে সাক্ষাৎ করে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা কথা বলেন। এর পরদিন হেফাজত আমির এক খোলা চিঠিতে দেশের তৌহিদি জনতাকে দেশ ও ঈমান রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। চিঠিতে তিনি নির্বাচনী তফসিল বাতিল করে দ্রুত রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধান না হলে দেশে মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
অভিশপ্ত রানা প্লাজা কাঁদিয়েছে বিশ্বকে:
সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল সারা বিশ্ব। ২৪ এপ্রিলের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১১৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধারের ঘোষণা দেয়া হয় সরকারিভাবে। যদিও মাটির নিচ থেকে মানুষের শরীরের অংশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে এখনো। ভবনের মালিক সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা সোহেল রানা কোনোরূপ নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে চারতলা ভবনের ওপরে তৈরি করেছিলেন আটতলা এ ভবন। প্রাথমিকভাবে এটিকেই ধসের কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়। ধসেপড়া ভবনের নিচ থেকে উদ্ধার করা দুই হাজার ৪৩৮ জন পোশাকশ্রমিক শরীরের অংশবিশেষ হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন, বরণ করেছেন স্থায়ী পঙ্গুত্ব।
বিদায়ী বছরের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টার কিছু পরের ঘটনা। রানা প্লাজা নামক এই ভবনে অবস্থিত পাঁচটি তৈরী পোশাক কারখানার সাড়ে চার হাজারের মতো শ্রমিক সবে কাজে যোগ দিয়েছেন। আগের দিনই ভবনে ফাটল দেখা দেয়ায় ওই দিন কাজ করতে চাননি তারা। স্থানীয় যুবলীগের কর্মীরা তাদের পিটিয়ে বাধ্য করেছিলেন ফাটল ধরা ভবনে কাজ করতে। একসাথে সবগুলো জেনারেটর চালু করতেই কেঁপে ওঠে পুরো ভবন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একে একে ধসে পড়ে আটতলা ভবনের সবগুলো ছাদ। মুহূর্তেই ইট-শুড়কির সাথে মিশে যায় হাজার হাজার তাজাপ্রাণ। যদিও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সে সময় বলেছিলেন, হরতালকারীরা পিলার ও গেট ধরে নাড়াচাড়া করায় ভবনটি ধসে পড়ে।
রানা প্লাজা ধসের মাধ্যমে কপাল পোড়ে দেশের অর্থনীতিরও। এ ঘটনার জের ধরে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে শ্রমিক বিক্ষোভে। ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর, কাঁচপুর, চট্টগ্রামসহ ১০টি তৈরী পোশাক কারখানা অঞ্চলে দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। এ ঘটনার জের ধরেই বাংলাদেশী তৈরী পোশাক সর্ববৃহৎ রফতানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন ধরে চলমান জিএসপি ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে দেয়। নানামুখী চাপ আসতে থাকে রফতানি বাণিজ্যে ৮০ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী তৈরী পোশাক পণ্যের বিদেশী ক্রেতাদের পক্ষ থেকে। ভারতসহ প্রতিযোগী দেশগুলো রানা প্লাজার দুর্ঘটনাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ে দেশ।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হতাহত শ্রমিকদের জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে সাহায্য আসে প্রচুর পরিমাণে; কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে এসব সাহায্য প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছায়নি। এ ঘটনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয় সরকারকে। ঘটনার ১৭ দিন পর রেশমা নামক এক শ্রমিককে জীবিত উদ্ধারের কথিত নাটক সাজাতে গিয়ে বির্তকের ডালপাল ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। বাংলাদেশী তৈরী পোশাক শিল্পের এই চরম দুর্দিনে যেসব বিদেশী সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল তারাও ফিরে গেছে। জড়িতদের বিচার বা শাস্তি না হওয়ায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায় অপরাপর অপরাধীরাও। ভেস্তে যায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সব উদ্যোগই।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি দুই মাসের মাথায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওই ভবনে থাকা পাঁচটি কারখানার মালিকের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলকব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবনে ফাটল দেখা দিলে ২৩ এপ্রিল সেখানে বিজিএমইএ’র প থেকে দুইজন সদস্যসহ স্থানীয় প্রশাসনকে সাথে নিয়ে কারখানা বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেন; কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে ২৪ এপ্রিল কারখানাটি চালু করে ভবনটির মালিক। এ ক্ষেত্রে তার পক্ষে মতামত দেন সাভারের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
তদন্ত প্রতিবেদনে ভবন ধসের ৯টি কারণ উল্লেখ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ছয়তলার অনুমোদন থাকলেও ৯ তলা নির্মাণ করা, কারখানায় নি¤œমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, ছয়তলা ভবনের ভার বহনে জন্য ৩৫০০ পিএসআই থাকার কথা; কিন্তু এই ভবনে ভার বহনের মতা ছিল ২৩০০ পিএসআই, কল-কারখানা পরিদর্শন বিভাগের অসচেতনতা, সাভার পৌরসভার সংশ্লিষ্ট বিভাগের অবহেলা, ধারণমতার অতিরিক্ত ভার বৃদ্ধি, অতিরিক্ত কাঁচামালসহ কাপড় ও তৈরী পোশাক মজুদ ইত্যাদি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশও করা হয়। এর মধ্যে রানা প্লাজার ভবন মালিক, কারখানা মালিক ও স্থানীয় প্রশাসন, সাভার পৌরসভার নকশা অনুমোদনকারীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ভবনের মালিক সোহেল রানাকে আটক করে রাখা ছাড়া আর কোনো অগ্রগতিই হয়নি। উপরন্তু সোহেল রানা নিজের মুক্তির জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, কখনো টর্চার সেল, কখনো গলা ডুবিয়ে নেশার বুদবুদ ওঠানো আর কখনো সুন্দরী নারীদের নিয়ে রাতভর ফুর্তিÑ সবই চলত ধসে পড়া রানা প্লাজায়। ভবন মালিক রানার আমন্ত্রণে এ আসরে যোগ দিতেন সাভারের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিও। রানা প্লাজার পুরো বেজমেন্ট বরাদ্দ ছিল কার পার্কিংয়ের জন্য; কিন্তু সেখানে কোনো কার পার্ক করা হতো না। কারণ পুরো পার্কিং এরিয়াতেই রানা তৈরি করেন বিনোদন কেন্দ্র আর টর্চার সেল। বিনোদনের জন্য সেখানে তৈরি করা হয় গোটা ত্রিশেক ছোট ছোট ক।
বেজমেন্টের প্রতিটি কে ছিল দু’জনের শোয়ার মতো একটি খাট। ছিল জুয়া খেলার জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করা বোর্ডরুম। ছিল বিভিন্ন প্রকারের মাদক সেবন, সংরক্ষণ ও বিক্রির জন্য ভিন্ন ভিন্ন কক্ষ। দেশের সীমান্তবর্তী নওগাঁ, যশোর, রাজশাহী থেকে ট্রাক ও নাইট কোচে করে ফেনসিডিলের চালান আসত রানা প্লাজায়। রাতের অন্ধকারে সেগুলো খালাস হতো রানা প্লাজার সামনেই। ২০০৮ সালে নবাবগঞ্জের গাজী আবদুল্লাহ নামের এক যুবলীগকর্মী খুন হন রানা প্লাজার এই বেজমেন্টে। সোহেল রানার বোনের সাথে প্রেম করার অপরাধে ১৯৯৯ সালে এখানেই খুন হন জাকির নামে সাভারের এক যুবক।
সাভার উপজেলা ও পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন খান ইমু নয়া দিগন্তকে বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক রবীন্দ্রনাথের জায়গা দখল করে তৈরি করার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় অবৈধ এ ভবনের। তারপর বিভিন্ন সময়ে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা এ ভবনে হয়নি। এমপি মুরাদের ছত্রছায়ায় বিগত দিনগুলোতে রানা প্লাজায় চলত খুন-খারাবি, গুম, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, নারী নিয়ে ফুর্তি করা থেকে সব কিছুই।
প্লাজার সামনেই কথা হয় স্থানীয় যুবক আলমগীরের সাথে। রানা প্লাজার বেজমেন্ট ফেনসিডিলের গোডাউন হিসেবে দীর্ঘ দিন ব্যবহৃত হয়ে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, রানা নিজেও মাদকসেবী এবং এসব অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত। এ ভবন থেকেই সাভারের ফেনসিডিল ব্যবসায় পরিচালিত হয়। সেই সুবাদে সাভারের উঠতি বয়সী মাদকসেবীরা সবাই সোহেল রানার অনুসারী। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক কর্মী সরবরাহের মতার কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের কাছে ছিল রানার বিশেষ কদর।
ব্যাংক কেলেঙ্কারির বছর:
দেশের ব্যাংকিং খাতে স্মরণকালের ভয়াবহ কেলেঙ্কারি হয় বিদায়ী বছরে। হলমার্ক নামক একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই বিসমিল্লাহ গ্রুপ নামক আরেক অখ্যাত প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র খাতের জনতা ব্যাংক ও আরো চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য বেরিয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি আনন্দ শিপইয়ার্ডের ঋণ কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্র মালিকানার বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ প্রদান, লোকবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ছিল বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং খাতের আলোচিত ঘাটনা। বিদ্যুৎ, গ্যাস সঙ্কট, অবকাঠামো সুবিধার অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সবশেষ রাজনীতির মাঠে টালমাটালে ব্যবসাবাণিজ্য স্থবিরতার কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, মুনাফায় ধসও ব্যাংকিং খাতের আলোচনায় ছিল। এর বাইরে জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও কৃষি ব্যাংক থেকেও কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি উদ্ধার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতিবিদদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ৯ রাজনৈতিক ব্যাংকের অনুমোদন দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনায় ছিল সারা বছর।
চীনের দুঃখ যেমন হুয়াং হো নদী, তেমনি ব্যাংক খাতের দুঃখ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে অখ্যাত কোম্পানি হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে অখ্যাত হলমার্ক কোম্পানিটি সোনালী ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এর সাথে সোনালী ব্যাংকের প্রায় তিন ডজন কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনা হয়। এ দিকে, হলমার্ক হাতিয়ে নেয়া অর্থের গন্তব্য নিশ্চিত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক বা দুর্নীতি দমন কমিশন। এসব অর্থ দেশে রাখা হয়েছে না বিদেশে পাচার করা হয়েছে, অর্থের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, কাদের অ্যাকাউন্টে টাকা চলে গেছে, তা এখনো অজানা রয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার দায়ে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় অর্থ মন্ত্রণালয়। উপরন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে যথাসময়ে ঋণ অনিয়ম বের করতে না পারার জন্য দোষারোপ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর বাইরে সরকারি মালিকানাধীন প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেই ঋণ কেলেঙ্কারি হয় বিদায়ী বছরে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদন্ত করা হয়। হলমার্কের রেশ কাটতে না কাটতেই পাঁচ ব্যাংকের সাথে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকসহ বেসরকারি খাতের প্রাইম, শাহজালাল, যমুনা ও প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে প্রায় ১৩ শ’ কোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যায়।
হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে নতুন ব্যাংক বাদে দেশের প্রায় সব ব্যাংকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব ব্যাংকের বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ। সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের অতিরিক্ত প্রভিশন রাখতে হয়। আর বাড়তি প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকের মুনাফায় ধস নামে। শুধু মুনাফায়ই ধস নামেনি ব্যাংকিং খাতে কয়েকটি বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির পর আস্থার সঙ্কট দেখা দেয় ব্যাংকিং খাতে। লেনদেনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের কেন্দ্রীয় অফিস তদারকি করায় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে পার হয়ে যাচ্ছে বেশি সময়। এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের স্বীকৃতি বিল কিনছে না। এ পরিস্থিতিতে আমদানি-রফতানিসহ ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। অনেক ব্যবসায়ী এর প্রভাবে ব্যাংকের খাতায় ঋণখেলাপি হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। এতে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে।
বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম : রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত খাতের বেসিক ব্যাংকে ব্যাপক ভিত্তিতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি শনাক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব অনিয়ম পর্যবেণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একজন পর্যবেক নিয়োগ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১-এর মহাব্যবস্থাপক অশোক কুমার দে-কে এ পদে নিয়োগ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পূবালী ব্যাংকের সরকারি অ্যাকাউন্ট থেকে ১০৮ কোটি টাকা গায়েব : বিদায়ী বছরে পূবালী ব্যাংকের সরকারি অ্যাকাউন্ট থেকে ১০৮ কোটি টাকা গায়েব হওয়ার ঘটনা ছিল আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখা, নরসিংদী জেলার মাধবদী শাখা ও নরায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক শাখা থেকে সরকারের এ ১০৮ কোটি টাকা খোয়া যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ঘটনা বের হওয়ার পর পূবালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ব্যাংকটির ১৫ জন ব্যাংক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স : গেল বছরে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স ছিল আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দীর্ঘ এক যুগ পর আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে দ্বিতীয় বারের মতো রাজনৈতিক বিচেনায় ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে দাতা সংস্থা আইএমএফ, সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ এবং স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অপাত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু তার পরেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়।
সারা বছরেই টাকার চাহিদা কম ছিল : বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সারা বছরই বিনিয়োগ চাহিদা ছিল না। আর বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় টাকার চাহিদাও ছিল না। টাকার চাহিদা না থাকায় ব্যাংকিং খাতে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। টাকার প্রবাহ কমাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়; কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ উদ্বৃত্ত তারল্যের বেশির ভাগই সরকারের কোষাগারে আটকে রয়েছে। অর্থাৎ বিল ও বন্ড বিনিময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে।
বিনিয়োগ মন্দার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের নতুন রেকর্ড : গেল বছরে আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম ছিল বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। বিনিয়োগ মন্দার কারণে রেমিট্যান্স, রফতানি আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। এ দিকে বিনিয়োগ মন্দার কারণে ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রা কাজে লাগাতে না পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করে। এসব কারণে বেড়ে যায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। সর্বশেষ হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দাঁড়ায় এক হাজার ৮০০ কোটি ডলার। যদিও এ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রেস রিলিজ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের রেকর্ডের খবর ফলাও করে প্রচার করে। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও ব্যাংকগুলোর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ঘন ঘন পরিবর্তনও ছিল বিদায়ী বছরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। চেক কিয়ারিংয়ে সার্ভিস চার্জ আরোপের ক্ষেত্রে অবস্থান পরিবর্তন, এসএমইসহ সব ধরনের খাতের ঋণখেলাপিদের ঋণ নবায়নের বিশেষ ছাড়সহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচিত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আলোচিত সমালোচিত এরশাদ:
২০১৩ সালের আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সাবেক এই সেনাশাসক গেল বছরের শেষ নাগাদ এতটাই আলোচিত ছিলেনÑ যা দেশের দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে তিনি সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন। তিনি দুই দিন আগে বলেছেন, বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ আমাকে থুথু দেবে। আবার দুই দিন পরই বলেছেন, এ অবস্থায় নির্বাচনে না গেলে মানুষ রাজনীতিবিদদের থুথু দেবে। তার এ ধরনের বক্তব্য নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহলের শেষ ছিল না। তাকে নিয়ে বিরূপ সমালোচনা ও মন্তব্যও করা হয়েছে। বিরোধী দলের টানা হরতাল-অবরোধ ও ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচি ছাড়াও সরকারের একতরফা নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় তিনি অনেকটা নীরবে-নিভৃতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার নামে আটক আছেন! তারপরও দেশের মানুষ তাকিয়ে আছেনÑ ৫ জানুয়ারির পর এরশাদ কী করেনÑ তা দেখার জন্য। তাকে নিয়ে বছরের সেরা উক্তি ছিলÑ ‘ম্যান ইজ এরশাদ’।
নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এরশাদ বলেছেন, সব দল ছাড়া আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনে গেলে জনগণ বেঈমান বলবে। আর যদি নির্বাচনে না যাই, তাহলে দেশে একতরফা নির্বাচন হবে। সে সরকার এক বছর কিংবা তারও বেশি সময় মতায় থাকতে পারে। সরকার পরিবর্তনের উপায় হচ্ছে তিনটি। একটা হলো নির্বাচন, দ্বিতীয়টি মিলিটারি ক্যু এবং অপরটি আর্মড রেভ্যুলেশন। প্রশ্ন হলোÑ জনগণ কোনটা বেছে নেবে? তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি আর মহাজোটে নেই। আমার ভাই জি এম কাদের মহাজোটের মন্ত্রী ছিলেন, তিনি পদত্যাগ করেছেন। শিগগির সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়া হবে। ওই দিন নতুন জোটেরও ঘোষণা দেয়া হবে।
এরশাদ বলেন, যদি নির্বাচন করি তাহলে জনগণ বলবে দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ সরকারকে আবারো মতায় বসানোর জন্য নির্বাচন করছেন এরশাদ। তাহলে মানুষ বলবে আমি বেঈমান। আমি বেঈমান হয়ে মরতে চাই না। আর নির্বাচন না করলে দেশ কোন দিকে যায় তা অনিশ্চিত। তবে একটাই উপায় নির্বাচনের মাধ্যমে এই দুর্নীতিপরায়ণ সরকারকে মতাচ্যুত করা। তবে জাতি অন্ধকারে যাক এমন কোনো কাজ আমি করব না। আমি একটা জোট করতে চেয়েছিলাম। জোট হয়তো করব। তা অচিরেই ঘোষণা করব। এরশাদ বলেন, দেশের বড় দু’টি দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। দুই দলই দেশের অভিশাপ। এই দুই রাহুর হাত থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে হবে। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করেছেন। পরে রাস্তা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছেন। আমরা সব জানি। এ জাতির মন তো আর ধুয়ে মুছে দিতে পারেননি।
এরশাদ বলেন, আমি সর্বদলীয় সরকারে যাচ্ছি, আওয়ামী লীগ সরকারে যাচ্ছি না। নির্বাচন কিভাবে হয় তা দেখার জন্যই যাচ্ছি। কোনো ধরনের কারচুপি হলে আমরা নির্বাচন বর্জন করে বেরিয়ে আসবো।
মহাজোট আর নির্বাচন নিয়ে এরশাদের যত কথা : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনানীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বিএনপিকেও নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেয়া ও নির্বাচনে আসার জন্য সরকারের সাথে আলোচনায় যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এ সিদ্ধান্তের খবরে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। কেউ কেউ এটাকে ’৮৬-এর প্রতিদান হিসেবেই মনে করছেন।
এরশাদ সাম্প্রতিককালে বলে আসছিলেন সবদল নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টিও সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না। এমনকি বিএনপি না এলে তিনিও নির্বাচনে যাবেন না। তিনি এও বলেছিলেন, সবদল বা বিএনপিবিহীন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তিনি জাতীয় বেঈমানে পরিণত হবেন। মানুষ তাকে থুথু দেবে। শেষ বয়সে বেঈমান হয়ে মরতে চান না।
এরশাদ গত ১৭ নভেম্বর দলের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তিনি এখন উভয় সঙ্কটে আছেন। ১২ নভেম্বর বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ তাকে থুথু দেবে। ওই দিন সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি গত ২৩ অক্টোবর ছোট ভাই জি এম কাদেরকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, বিএনপিসহ সব দল না এলে ওই নির্বাচনে জাপাও যাবে না। তার আগের দিনও তিনি একই কথা বলেছেন। ১৪ অক্টোবর বলেছেন, আওয়ামী লীগ আবারো বাকশাল কায়েমের চেষ্টা করছে। ২৭ সেপ্টেম্বর বলেছেন, আওয়ামী লীগ গণধিকৃত দল। আগামী নির্বাচনে ৬০টি আসনও পাবে না। ২৫ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দালাল হওয়ার নির্বাচনে অংশ নেবো না। ধ্বংস হয়ে যাবো, তবু দালাল হবো না। দালাল হয়ে মরতে চাই না। সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে ২২ সেপ্টেম্বর সরকারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, কারসাজি করে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। আগের দিন যুদ্ধাপরাধ মামলায় কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর তা আবার জাতীয় সংসদে আইন করে পরিবর্তন করে সরকার। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, রায়ের পর আইন পরিবর্তনের নজির পৃথিবীর কোথায় নেই।
১৭ সেপ্টেম্বর সিলেটের এক দলীয় সমাবেশে এরশাদ বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে সে নির্বাচনে জাতীয় পার্টিও যাবে না। মহাজোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন নামমাত্র মহাজোটে আছি। যারা আস্তিক-নাস্তিক তৈরি করেছেÑ তাদের সাথে আর কোনো নির্বাচন নয়। আমি নাস্তিকের পে নেই। আমি ইসলামের পে আছি। ২৫ আগস্ট বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত আখ্যায়িত করে তিনি বলেছেন, এই বিতর্কিত ইসির অধীনে কোনো নির্বাচন করতে চাই না।
মহাজোট ও জোট প্রসঙ্গে ২২ আগস্ট তিনি বলেছেন, জাপা কারো ডাকেই সাড়া দেবে না। ১২ আগস্ট বলেছেন, আওয়ামী লীগের পাশে কেউ নেই। ১০ আগস্ট জাপা সমর্থিত এক গবেষণা জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, দেশের শতকরা ৮৩ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় এবং ৮৪ ভাগ মানুষ বলেছেন ঠিকভাবে চলছে না দেশ। ৯ আগস্ট বলেছেন, গাজীপুরের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত। ২৮ জুন বলেছেন, মহাজোটে জাতীয় পার্টি না থাকলে সরকারের অস্থিত্বই থাকে না। ২ জুন বলেছেন, দুই নেত্রী একসাথে লড়লেও রাষ্ট্রপতি পদে আমার বিরুদ্ধে জয়ী হবে না। ২৬ মে এক সমাবেশে বলেছেন, বিএনপি না এলে নির্বাচন হবে না। সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। ২ মার্চ বলেছেন, দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এর আগে ১৭ মার্চ তিনি মার্কিন সফরকালে সে দেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশের রাজনীতির অনিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি তাদের বলেছেন, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছেÑ তা দূর করতে সরকারকে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছি। সেখানে জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট দলের মনোনীত নির্দিষ্ট সংখ্যক (১১ জনের বেশি নয়) সদস্যদের সমন্বয়ে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচিত জাতীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। ওই সরকারের নেতৃত্বেই সবদলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা যেতে পারে। এরশাদ বছরের শুরুতেই ১৪ জানুয়ারি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ আমার প্রতি সুবিচার করেনি। আগামী নির্বাচনে আমিও সুবিচার করব না।
নির্বাচনে যাব না, আমিই জাপার চেয়ারম্যান : এরশাদ
এরশাদকে নিয়ে নানা নাটকীয়তা। গুজব জাতীয় পার্টিতে। এরশাদ সাংবাদিকদের বললেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমিই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান থাকব। অন্য কারো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ নেই। আমি যত দিন বেঁচে আছি তত দিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমিই থাকব। মিডিয়াগুলো যতই অপপ্রচার চালাক আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। সব দল নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না, যাবে না, যাবে না। তিনি বলেন, আমার দলের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করুক আর না করুক, আমি নির্বাচনে যাব না। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হচ্ছেন’ এমন সংবাদের পরিপ্রেেিত তিনি এ কথা বললেন। এরশাদ বলেন, গণমাধ্যম বাড়াবাড়ি করছে। কাজী জাফরের বরাত দিয়ে রওশন এরশাদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়ে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমিই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা অবশ্যই পদত্যাগ করবে। পদত্যাগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। সব দল নির্বাচনে না গেলে আমি নির্বাচন করব না।
বন্ধ গণমাধ্যম বেকার সহস্র কর্মী:
বন্ধ গণমাধ্যম নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক কথা হলেও সরকার বছরের শেষ দিন পর্যন্ত তা খুলে দেয়নি। ১৪ এপ্রিল আমার দেশ প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় সরকার। আল ফালাহ প্রেস থেকে ছাপানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তা আটকে দেয়। এর আগে পুলিশ আমার দেশের তেজগাঁও প্রেসে তালা মেরে দেয়। তালা মারার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন চললেও এর সমাধান হয়নি। উল্টো আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মা মাহমুদা বেগমের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। মামলা হয় সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধেও।
শাহবাগে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সর্বনিম্ন সাজা মৃত্যুদণ্ড দাবি করে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হওয়ার পর সেখানকার ফ্যাসিবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে আমার দেশ একটি লিড স্টোরি করে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য মহাজোট সরকারের গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসে আমার দেশ।
এর পর পরই আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে দাবি ওঠে। পরে মাহমুদুর রহমানকে আমার দেশের কারওয়ান বাজারের অফিস থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এখনো তিনি জেলেই আছেন। মাঝখানে তিনি পত্রিকাটি খুলে দেয়া ও তার মায়ের মামলা প্রত্যাহার চেয়ে অনশনও করেছিলেন। তবে সরকার তার নিজের নীতিতে অটল থাকে।
আমার দেশের কর্মীরা বেকার হয়ে পড়েন। এখন পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সন প্রকাশ পাচ্ছে। তবে কর্মীদের বেতনভাতা ও সঙ্কট কাটেনি। এ রকম সাংবাদিকদের বেকারত্ব বাড়তে থাকে চলতি বছর।
৫ মে হেফাজতে ইসলামের মতিঝিল অবস্থানের খবর প্রচারের ‘অপরাধে’ দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের দ্বিতীয় উদ্যোগ দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয় সরকার। নির্বাহী আদেশে এ দুটো টিভি স্টেশন বন্ধ করে দিলে কয়েক শ’ কর্মী বেকার হয়ে পড়েন।
সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন, তারা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেলে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি খুলে দেবেন। তবে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত তা হয়নি। তবে এ বছর খুলে দেয়া হয়েছে বন্ধ যমুনা টেলিভিশন ও অনলাইন শীর্ষ নিউজ। তবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অনলাইন নিউজ বিডি টুডে ডট কম।
বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেয়ার দাবি বছরজুড়ে করে আসছিলেন সাংবাদিকেরা। বিভিন্ন মত-পথের ১৫ জন সম্পাদক ১৮ মে এক যৌথ বিবৃতিতে আমার দেশ, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি খুলে দেয়ার দাবি করেন।
এ বিবৃতিতে সই করেছিলেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার, বাংলা দৈনিক প্রথম আলো, সমকালসহ বিভিন্ন কাগজের সম্পাদকেরা। বিবৃতিটি নিয়ে আবার কিছু দলকানা সাংবাদিক ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। একজন সম্পাদক তার সই দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে সব কিছুর পরও কথা হলোÑ গণমাধ্যম যে বিপন্ন এবং এর পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে সেটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন সম্পাদকেরা।
তিনটি বড় গণমাধ্যম বন্ধ হওয়ার কারণে কমপক্ষে এক হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন। মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ।
অন্য দিকে বছরের শেষ দিকে এসে ফটোসাংবাদিক আফতাব খুন হয়েছেন। সাগর-রুনি হত্যার কোনো কিনারা করতে পারেনি সরকার। প্রেস কাব আক্রমণের শিকার হয়েছে।
বছরজুড়েই আলোচনায় হত্যা-গুম:
বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এর মধ্যে হত্যা ও গুমের ঘটনা ছিল সর্বাধিক আলোচিত। গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পরে প্রায় অর্ধশত মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগ তারা গুম হয়েছেন। এ দিকে অনেক মানুষের লাশ মিলেছে; কিন্তু পরিচয় মিলেনি। বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনা ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ঘটলেও ২০১৩ সালের পুরো সময়টিই মানুষের মুখে মুখে ছিল ছাত্রলীগের ওই নৃশংসতার কথা। এক বছরের মাথায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে ২১ ছাত্রলীগ ক্যাডারের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।
২০১৩ সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ অনেক মানুষ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে। তাদের মধ্যে অনেককেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দীর্ঘ দিন পর ফিরে আসার ঘটনাও ঘটেছে। তবে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি সেই যে নিখোঁজ হয়েছেন আর ফেরত আসেননি। মিলেনি তাদের লাশও।
উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা : গত ২৫ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জাসদ নেতা মোহাম্মদ আলী মহব্বত খুলনার জাহানবাদ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গুম করে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৪ মে রাজশাহীর মতিহার থানার কাজলা এলাকার বাসিন্দা আবদুল্লাহ উমর নাসিফ শাহাদাতকে রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে আটক করা হয়। তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় নাসিফকে গুম করা হয়েছে। ১১ মে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন মগবাজারের বাসিন্দা মো: ফখরুল ইসলাম। ৪ এপ্রিল রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের অফিস সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম মাসুমকে আটক করা হয়। সে থেকেই নিখোঁজ তিনি। ৪ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়র সহসভাপতি মফিজুল ইসলাম রাশেদকে সাদা পোশাকের কিছু লোক ধরে নিয়ে যায়। সে থেকেই নিখোঁজ রাশেদ। গত ২৪ জুন রাজধানীর বাড্ডার শাহজাদপুর এলাকা থেকে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে। তারা হলেনÑ তাজাম্মুল আলী ও আজিজুর রহমান। ২৬ জুন তুলে নেয়া হয় আব্দুস সালাম ও নুরুল আমিন নামে আরো দুই যুবককে। গুলশান থানাসংলগ্ন এলাকা থেকে তাদের তুলে নেয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সে থেকেই তারা নিখোঁজ রয়েছেন। গত ১১ এপ্রিল রাতে জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ও জয়পুরহাট তালিমুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বাসা থেকে নিখোঁজ হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়। বেশ কিছু দিন পরে তিনি একবার ফিরে এসে আবারো নিখোঁজ হন বলে জানা যায়।
বিরোধী দলের আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠলে হঠাৎ করেই আবার বেড়ে যায় গুমের ঘটনা। গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বারিধারা এলাকা থেকে তিন ছাত্রদল কর্মী নিখোঁজ হয়েছেন। তারা হলেনÑ আসাদুজ্জামান রানা (২৭), মাজহারুল ইসলাম রাসেল (২৬) ও আল আমিন (২৭)। তারা তিনজনই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তারা। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি, লাকসাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও লাকসামের সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ গত ২৭ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ। গত ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) এমএলএসএস মো: মাহফুজ সার্কিট হাউজ রোড থেকে নিখোঁজ হন। একটি সাদা মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নিয়ে যায় কে বা কারা। সে থেকেই নিখোঁজ তিনি। গত ২৭ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন জামায়াত কর্মী মেহেদী হাসান ফারুকী (৩৩)।
সর্বাধিক আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড : বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে খুন করে বিশ্বজিৎকে। বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল ছাত্রলীগের সেই নৃশংসতার কথা। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের একজন সাক্ষী রিকশাচালক রিপন আদালতে সাক্ষ্য প্রদানকালে বলেছেন, ‘ঘটনার দিন সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে আমি ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে রিকশা নিয়ে দাঁড়ানো ছিলাম। ওই দিন ছিল অবরোধ। ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। ছাত্রলীগের ছেলেরা আইনজীবীদের ধাওয়া দিয়ে জজ কোর্টের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। ফিরে আসার সময় ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে ডেন্টাল কিনিকের মাঝখানে একটা বোমা বিস্ফোরিত হয়। কিছু ছেলে ধাওয়া করে ওই কিনিকের দোতলায় নিয়ে বিশ্বজিৎকে লোহার রড দিয়ে মারে। কিছুণ পরে নিচে থেকে দেখি একজন একটা চাপাতি বের করে। এ সময় বিশ্বজিৎ চিৎকার করে বলতে থাকে ভগবানের দোহাই লাগে আমি বোমা মারিনি, আমি বোমা মারতে পারি না। তারপরও তারা বিশ্বজিৎকে মারতে মারতে কিনিকের ভেতরে নিয়ে যায়।’
সাক্ষ্য প্রদানকালে তিনি বলেন, ‘একটু পরে বিশ্বজিৎকে রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে। নিচে এনেও তার পিঠে ও মাথায় লোহার রড দিয়ে পেটায়। বিশ্বজিৎ বাঁচার জন্য দৌড় দেয়। কোর্টের পেছনে শাঁখারী বাজারের রাস্তার সামনে যেতেই বিশ্বজিৎ পড়ে যায়।
তখন আমি আমার রিকশা নিয়ে সেখানে যাই। এক মহিলা বলে এটা কি বিশ্ব না! আমি মহিলাকে বলি, আপনি তাকে চেনেন কি না? মহিলা বলে শাঁখারী বাজারে তার টেইলারিং দোকান আছে। তাকে নিয়ে তার দোকানের দিকে গেলে বিশ্বজিৎ জল জল বলে গোঙ্গাতে থাকে। সেখানে এক মহিলা তাকে পানি দেয়। আমি তাকে রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আউটডোরে নিয়ে বলি কোপানো রোগী আনছি। আউটডোরের ডাক্তার বলে এর গার্ডিয়ান কোথায়? এ সময় শোয়ানো অবস্থায় ট্রলি তার শরীরের রক্তে ভেসে যায়। কিছুণ পর তার ভাই উত্তমকে ডাক্তার বলে সে মারা গেছে। আমি উত্তমকে বলি ডাক্তারের অবহেলায় বিশ্বজিৎ মারা গেছে।’ অভিযোগ পাওয়া গেছে এই রিপন তার রিকশায় করে বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নেয়ায় এবং সর্বশেষ আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করায় তাকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়।
এই ঘটনায় চলতি বছরের ৫ মার্চ ছাত্রলীগের ২১ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক তাজুল ইসলাম। যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে তারা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী। গত ২ জুন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কারাগারে থাকা আটজন ও পলাতক অপর ১৩ আসামিসহ মোট ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এ দিন পলাতক আসামিদের বিরেুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। বিচারিক কার্য সম্পাদনের পরে গত ১৮ ডিসেম্বর এই মামলায় আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ১৩ জনকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা হয়।
এ ছাড়া বিগত বছরে সারা দেশে খুন হয়েছেন চার হাজার ৩৪৮ জন নারী ও পুরুষ। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৪৫২ জন বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।
প্রশ্ন ফাঁসের মহোৎসব বছরজুড়ে:
বছরজুড়ে শিাঙ্গনে পরীাসহ সর্ব েেত্র নিয়োগসংক্রান্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। কী ভর্তি পরীা, পাবলিক পরীা, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সব ধরনের নিয়োগে, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা নিয়োগ এমনকি ছোট্ট সোনামণিদের জন্য এসএসসি খ্যাত প্রাথমিক সমাপনী পরীা কোনোটিই প্রশ্ন ফাঁস হওয়া ছাড়া শেষ হয়নি। পাবলিক পরীাগুলোতে প্রশ্ন ফাঁসকে শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ কর্তব্যক্তিরা প্রবীণ শিকদের সাজেশন বলে বিগত দুই বছর চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও এ বছর তাতে সফল হননি তারা। সংবাদপত্রগুলো পরীার আগেই প্রশ্ন ফাঁসের খবর প্রকাশ করে শিামন্ত্রীকে অনেকটা বেকায়দায়ই ফেলে দিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন ‘মুখ রার’ স্বার্থে। কিন্তু তদন্ত কমিটি সুুনির্দিষ্টভাবে কাউকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে নিয়োগ পরীার প্রশ্ন ফাঁসের পর অর্থের বিনিময়ে সেসব নিয়োগ দানে সরকারসমর্থক ছাত্র সংগঠনের কোনো পর্যায়ের কর্মীরা জড়িত। সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংকের নিয়োগ পরীার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এ সব প্রশ্ন ফাঁসের সাথে ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালকদের মধ্যে সাবেক ছাত্র নেতা হিসেবে চিহ্নিতরাই বেশির ভাগ েেত্র সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন পরীার প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে এই আমলে বিশেষ করে সরকারে শেষ বছরে। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিসিএসের সব ক’টিতে (২৯তম থেকে ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত), গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, সরকারি প্রাথামিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক নিয়োগ, অডিট, এনবিআর, সহকারী প্রাথমিক এটিইও, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীা, প্রাথমিক সমাপনী পরীা, জেএসসি পরীা, এসএসসি, এইচএসসি, সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীাসহ ৩০টির অধিক পরীার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে।
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের ভিত্তিতে স্থগিত করা হয় ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীা ও অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সূত্র, বিশিষ্টজন ও চাকরি প্রার্থীদের মতে, বর্তমান সরকারের আমলের মতো অতীতে এত বেশি ও গণহারে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি। সংশ্লিষ্টদের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত গত ২৯ বছরে ৫৫টি বিভিন্ন ধরনের পরীার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। আর মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরেই অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ধরনের ৩০টি পরীার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।
বর্তমান মহাজোট সরকার মতা নেয়ার পর প্রশ্ন ফাঁস নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাদ পড়ছে না শিশু-শিার্থীদের জীবনের প্রথম পাবলিক পরীা প্রাথমিক সমাপনীর েেত্রও। বাদ যাচ্ছে না পিএসসির অধীনে নেয়া বিসিএসের মতো পরীার প্রশ্ন ফাঁসও। প্রশ্ন ফাঁসের সর্বশেষ শিকার হয়েছে প্রাথমিকের শিশুশিার্থীরা।
প্রাথমিক সমাপনী পরীায় সব ক’টি বিষয়ের প্রশ্নই পরীার বেশ কিছু দিন আগেই ফাঁস হয়। প্রাথমিক সমাপনী পরীার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিা ডা: আফসারুল আমিনের দৃষ্টিগোচরে আনার পরপরই তিনি পরীা স্থগিতের নির্দেশ দিলে তা কার্যকর হয়নি। পরের দিন এক অভিভাবক পরীার আগের রাতে পাওয়া প্রশ্ন প্রাথমিক শিা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালকের ই-মেইলে পাঠিয়ে দেন। আর সেই প্রশ্নের সাথে মিলে যায় পরদিন অনুষ্ঠিত ইংেরেজি পরীার প্রশ্ন। নয়া দিগন্তসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছাপানো হলে অনেকটাই বেকায়দায় পড়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন প্রাথমিকের তৎকালীন মন্ত্রী ডা: আফসারুল আমিন। এর পরপরই তৎকালীন মন্ত্রিসভা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পদত্যাগের পর নতুন করে প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি দায়িত্ব নেয়ার তদন্তে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়। তিনি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রেই পরীা চালু রাখার নির্দেশ দেন এবং পরীা শেষ হওয়ার ১৫ দিন পর তদন্ত কমিটিকে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র জাতীয় দৈনিকে ছাপা হলেও তদন্ত কমিটি তিন-চারটি জেলায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ খুঁজে পান এবং মাত্র ইংরেজি ৮০ শতাংশ ও বাংলার ৫০ শতাংশ মিল পান। তবে ফাঁসের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত কাউকেই তদন্ত কমিটি চিহ্নিত করতে পারেনি। অভিভাবকেরা অভিযোগ করেন, শুধু গণিত, বাংলা কিংবা ইংরেজি বিষয়ই নয়, প্রাথমিক সমাপনীর সব বিষয়েরই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে আলোচিত একটি মামলা ও ফাঁসি:
শুধু বাংলাদেশ নয়, ২০১৩ সালে বিশ্বজুড়ে আলোচিত একটি ঘটনা ছিল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা ও তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা। আগে থেকেই নানা কারণে বছরজুড়ে আলোচিত ছিল এ মামলা। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করার ঘটনার কারণে শেষ মুহূর্তে এসেও এ মামলার মাধ্যমে ইতিহাসে যোগ হয়েছে আরো একটি স্মরণীয় অধ্যায়।
সরকারের নির্দেশে ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। সেই রাত ৮টায় আবদুল কাদের মোল্লার সাথে আত্মীয়স্বজনেরা শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়। ওই দিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দু’জন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষণা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হবে। কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দেশের ও বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক ভিড় করেন আলোচিত এ ফাঁসির খবর সংগ্রহের জন্য। ফাঁসি কার্যকরের এ আয়োজন প্রায় যখন সম্পন্ন, তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বাসভবনেÑ ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করা এবং রিভিউ আবেদন নিয়ে। ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর পরের দিন বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত রাখার আদেশ দেন। এর মাধ্যমে আরো একবার বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঘটনাবহুল ও আলোচিত এ মামলাটি।
বুধবার দেশবাসীর দৃষ্টিনিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রতি। সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামিপক্ষ ফাঁসি কার্যকর স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে আপিল বিভাগে। রিভিউ আবেদন চলবে কী চলবে না এ বিষয়ে বুধবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা মুলতবি করা হয়। ফলে ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে আসামিপক্ষ। বৃহস্পতিবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে দুপুর ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি আবেদন ডিসমিসড বা খারিজ ঘোষণা করেন।
এরপরই সরকারপক্ষ থেকে বলে দেয়া হয় আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরে আর কোনো বাধা নেই এবং যেকোনো সময়ই তা করা হবে। অপর দিকে আসামিপক্ষ দাবি করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে না। কারণ কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি। তাই কোর্ট থেকে কোনো নির্দেশনা কারাগারে না গেলে তারা ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে না।
তবে বৃহস্পতিবারই সব বিতর্ক শেষ হয়ে যায় যখন খবর বের হয় বিকেল ৩টার পর রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যসব স্থানে পাঠানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিস থেকে। তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় সে রাতেই কার্যকর হবে ফাঁসি। এভাবে সমাপ্তি ঘটে আবদুল কাদের মোল্লার মামলার শেষ মুহূর্তের স্মরণীয় অধ্যায়ের।
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার কারণে বারবার বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয় মামলাটি। ট্রাইব্যুনালের দেয়া কাদের মোল্লার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন; যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উত্থান হয় হেফাজতে ইসলামের শেষ পর্যন্ত যা গড়ায় অপারেশন শাপলা পর্যন্ত। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, আবদুল কাদের মোল্লা মামলা এবং এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা একপর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। শাহবাগের ধারাবাহিকতায় অপারেশন শাপলা এবং এরপর অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে সরকারপক্ষের ধরাশায়ী হওয়ার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু তথা আবদুল কাদের মোল্লা ইস্যু তাই বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ ছাড়াও আইনি গুরুত্বের কারণে এ মামলা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি আলোচিত ঘটনা হিসেবে স্থান করে নেবে। কারণ এই বিচারের রায় হয়ে যাওয়ার পর আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচারিক আদালতের দেয়া সাজা বাড়িয়ে আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, যা অতীতে এ দেশে কখনো হয়নি বলে দাবি আসামিপক্ষের।
চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন সাজার রায় দেন। এ রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনকারীদের দাবি আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয় সরকারপক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে। আইন সংশোধনের পর সরকার আবদুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে।
ট্রাইব্যুনাল আইনে আগের বিধান ছিল আসামিপক্ষই কেবল সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামির কোনো রকম সাজা হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল না। আসামিকে খালাস দেয়া হলে সে ক্ষেত্রেই কেবল রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে উভয়পক্ষকেই আপিলের সুযোগ দেয়া হয় এবং সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, আইনের এ সংশোধনীকে ২০০৯ সাল থেকে কার্যকারিতা প্রদান করা হয়।
আইনটির পরিবর্তন এবং সে সংশোধনীকে রেট্রোঅ্যাকটিভ করার ফলে সৃষ্ট সুযোগে সরকারপক্ষের করা আপিল আবেদনের ওপর দীর্ঘ শুনানি শেষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আবদুল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন। প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ ১৭ সেপ্টেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন। আপিল বিভাগ থেকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ৫ ডিসেম্বর।
১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় আবদুল কাদের মোল্লার।
আবদুল কাদের মোল্লার মৃতুদণ্ড কার্যকরে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুন দুুঃখ প্রকাশ করেছেন। মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আলেম হিসেবে খ্যাত ইউসুফ আল কারজাভির নেতৃত্বে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী ব্লু মস্ক এবং ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ আরো অনেক দেশেও নামাজে জানাজা এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
এর আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত রাখার জন্য জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার নাবি পিল্লাই অনুরোধ জানান। অনুরূপ অনুরোধ জানান জাতিসঙ্ঘের দু’জন বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অনেক সংস্থা, বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান আইনজ্ঞ, বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য রায় কার্যকর স্থগিত রাখার অনুরোধ জানান বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। এসব সংস্থা এবং ব্যক্তি আগে থেকেই এ বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। বিশ্বসম্প্রদায়ের এ সব দাবি উপেক্ষা করে কার্যকর করা হয় ফাঁসি। ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তান পার্লামেন্টে এর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাসের পর আলোচনার নতুন আরেকটি অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে এ মামলা।