ব্রেকিং নিউজ
Home / অর্থনীতি / ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সবার সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সবার সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

 

করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এমন অবস্থানকে সমর্থন করলেও লকডাউনের প্রভাবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কত মানুষ বেকার হবে এবং সরকারি চাকরিজীবীর বাইরে সাধারণ মানুষ কিভাবে তাদের সংসারের ব্যয় বহন করবে তা ভেবে দেখার আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া কঠোর লকডাউনের প্রাক্কালে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে এমন আবেদন জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী মহলসহ সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীরা।

শনিবার তাদের অনেকে বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কঠোর লকডাউন আরোপ করে সার্বিক অর্থনীতির চাকাকে কিভাবে সচল রাখা হবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এদের বেশিরভাগই দিন আনে, দিন খায়। মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতেই বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলে এদের বেতন-ভাতায় আঘাত আসে। চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তো রয়েছেই। আছে ব্যাংকের দায়-দেনা ও কিস্তি পরিশোধের চাপ। দায়িত্বশীল মহল থেকে এসব প্রশ্নের সঠিক জবাবও আসতে হবে। ফলে কঠোর লকডাউন আরোপিত হলে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় মোটা দাগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একেবারে রাস্তার ভিক্ষুক থেকে সমাজের উচ্চবিত্ত শিল্পপতিরাও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। যে যত বড়, তার ক্ষতির পরিমাণ তত বেশি হবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘করোনাকালীন আর্থিক প্রণোদনা সহায়তার ব্যাপারে আগের অবস্থানেই আছে সরকার। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু করোনা এখনও শেষ হয়নি। যেহেতু নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রণোদনাসহ অন্যান্য নীতি সহায়তা বহাল থাকবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে প্রণোদনা ঋণের বড় অংশ পেয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীরা। কারণ তারা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট। তাদের সহজে খুঁজে বের করা যাবে। সে বিবেচনায় এবারও সরকার এগিয়ে আসবে। তবে এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। শ্রমিকরা যাতে চাকরিচ্যুত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এই লকডাউন অর্থনীতিকে লন্ডভন্ড করে দেবে। আর অর্থনীতির বিপর্যয় ডেকে আনলে সব খাত বিপদে পড়বে। ভিজিলেন্স বা চলমান অর্থনীতি যারা পড়েছেন, এমন কেউ লকডাউনের পক্ষে কথা বলবেন না। তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যাংক বিপদে পড়বে, শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নিু আয়ের মানুষের আয় বন্ধ হবে, শ্রমিকদের মজুরি বন্ধ হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয়ও কমবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার অত্যন্ত দুঃখ লাগে যে, টেলিভিশনে কেউ কেউ লকডাউনের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তাদের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন, এক সপ্তাহ পর কী করোনা দেশ থেকে চলে যাবে। যদি না যায়, তবে অর্থনীতির গতি থামিয়ে দেওয়ার মানে কী? এর দায় কে নেবে? ওইসব লোকদের আমি বলতে চাই, আগে অর্থনীতি বোঝেন, পরে মন্তব্য করেন। কিন্তু লকডাউনের মতো সিদ্ধান্তে পুরো দেশের অর্থনীতি এবং আর্থসামাজিক খাতে কী প্রভাব পড়বে, উনারা সেটি ভাবেন না। সামনে ঈদ চলে আসছে। সব খাতের মানুষের এ সময়ে আয় বাড়ে। আর ঈদকে সামনে রেখে সব উদ্যোক্তাই যার যার জায়গা থেকে নতুন বিনিয়োগ করেছেন। কারণ প্রতি বছর এ সময়ই অর্থনীতির গতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সময়। আর গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে লকডাউন দিয়ে অর্থনীতির ক্ষতি করার মানে কী?’

ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট অনেকে অধ্যাপক আবু আহমেদের মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে জানিয়েছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। কেননা লকডাউনের প্রভাবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। এতে উদ্যোক্তারা যেসব পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করছেন বা করবেন, সেগুলো বিক্রি করা সম্ভব হবে না। রপ্তানিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বায়ারদের অর্ডার বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাংক থেকে সুদের হিসাব কষা থামবে না। এ করোনার মধ্যেও ঋণের কিস্তি ঠিকই দিতে হচ্ছে। এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় ধাক্কা।

এদিকে এ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য খরচও মেটাতে হচ্ছে। সামনে আসছে ঈদ। সেখানে সময়মতো বেতন-ভাতা পরিশোধের বড় চাপ তো অপেক্ষা করছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেখানে করোনার প্রথম ধাক্কার ক্ষতি এখনও উদ্যোক্তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি; সেখানে দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হয়ে গেছে। ফলে সব কিছু তছনছ হতে বসেছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এ ধাক্কার প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে এবং সরকার যদি উদ্যোক্তাদের পাশে শক্তি সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয় তাহলে সবার পথে বসার উপক্রম হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে।

এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনার সংক্রমণ রোধে লকডাউনের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি অর্থনীতিকে সচল না রাখারও কোনো বিকল্প পথ নেই। তারা মনে করেন, করোনার প্রকোপ থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে হলে যেমন কঠোর লকডাউনের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি সামগ্রিক অর্থনীতিসহ কোটি কোটি মানুষের সংসার বাঁচাতে কার্যকর কিছু একটা করতে হবে। ফলে সরকারকে এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করে মানুষের জীবন ও জীবিকার সমাধানে ভূমিকা রাখতেই হবে।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্পের অগ্রসর ও পশ্চাৎপদ শিল্পকে লকডাউনের আওতায় আনা কোনো ক্রমেই উচিত হবে না। কারণ গত বছর লকডাউনের পর কারখানা খুলে দিলে এ খাতে তেমন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া এখন প্রতিটি রপ্তানিমুখী কারখানাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালনা করা হচ্ছে। বরং কারখানা বন্ধ করে দিলে বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।

শুক্রবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেছে। এর সংক্রমণ ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশে সর্বাত্মক লকডাউন দেওয়া হবে। এর আওতায় জরুরি সেবা ছাড়া অন্য সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা, গণপরিবহণও বন্ধ থাকবে।

একই দিন একই কথা জানিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, জরুরি সেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হবে। এরপর থেকে মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানসহ আয়-রোজগার চালু রাখা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়।

এর আগে গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটির আওতায় চলে লকডাউন। যা টানা ৬৬ দিন অব্যাহত থাকে। এরপর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত আকারে সচল করা হয়। একপর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সেক্টর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। লকডাউনের সময় সীমিত আকারে বিশেষ করে রপ্তানি, উৎপাদন ও ভোগ্যপণ্যের কার্যক্রম চলছিল। তবে ওই সময়ে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছিল তা কাটিয়ে উঠতে সরকার ২১টি প্যাকেজের আওতায় এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। যা দেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১১টি রয়েছে ঋণনির্ভর। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোট প্যাকেজের ৫৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ৪৪ শতাংশ বাস্তবায়নের জন্য প্যাকেজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের কারণে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। প্রণোদনা নিয়েও উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। তবে তারা যখন আগের ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন তখনই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত হামলে পড়েছে। এ অবস্থা সামাল দিতে গত ৫ এপ্রিল থেকে চলা সীমিত আকারের ‘লকডাউনের’ মেয়াদ শেষ হবে আজ রোববার। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ার কথা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম ধাক্কার ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার থেকে উদ্যোক্তারা প্রণোদনার যে ঋণ নিয়েছেন এবং এর আগের ঋণের কিস্তিও গত জানুয়ারি থেকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সমন্বয় করে পরিশোধ করতে হচ্ছে গত বছর ও চলতি বছরের সুদ। এর সঙ্গে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতা, অফিস খরচসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। লকডাউন আরোপিত হলে ব্যবসা বাণিজ্য সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে টাকার হাতবদল বা ব্যবহারও কমে গেছে। এতে ব্যবসায়ীরা অর্থ সংকটে পড়বে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে চেপে বসা দায়দেনা কিভাবে পরিশোধ হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। যদিও এ প্রশ্নের সদুত্তর দায়িত্বশীল মহলের অনেকে এড়িয়ে গেছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি বছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে ২০ লাখ শ্রমিক। এদের মধ্যে কর্মসংস্থান হচ্ছে ছয় লাখের। বাকি ১৪ লাখই থেকে যাচ্ছে বেকার। করোনার প্রভাবে গত বছরের এপ্রিল-জুলাইয়ে বেকার হয়েছিল ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ মানুষ চাকরিজীবী। সেপ্টেম্বরে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশে। অর্থাৎ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। এখন আবার ‘লকডাউনে’ সেই গতি থমকে দাঁড়াবে।