দেশের রাজনীতিতে বেশ আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক। হেফাজতকে কাছে টানতে এক সময় কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি এবং তাদের সমন্বিত শিক্ষাবোর্ড করে দেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। হেফাজতের নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একই টেবিলে কথাবার্তাও বলে ক্ষমতাসীনরা। জবাবে নির্বাচনের আগে শুকরানা সমাবেশ করে দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দিয়ে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয় হেফাজত। এই ইতিবাচক অতীত ছাপিয়ে এখন সে সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে চলে গেছে। বলা যায়, মুখোমুখি অবস্থানে আওয়ামী লীগ-হেফাজত।
গত মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতায় হেফাজতের অবস্থানকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের শেষ কোথায়? এ নিয়ে কী ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ? হেফাজতেরইবা ভাবনা কী? রাজনীতিতে এর প্রভাব কতটুকু? রাজনীতি-সচেতন সবার মুখে মুখে এখন এসব প্রশ্ন।
এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তাদের সামনে দুটো পথ—কওমি মাদরাসার বিশাল ছাত্রগোষ্ঠীর প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করে তাদের মূলস্রোতে নিয়ে আসা। যেন তাদের ওপর হেফাজত নেতাদের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনা যায়। পাশাপাশি ছাত্রদের নানাভাবে উসকে দিয়ে যারা রাজনৈতিক ফায়দা লোটে, তাদের কঠোরভাবে দমন করা। ভবিষ্যতে যেন এমন পরিস্থিতি আর তৈরি না হয়।
ইতোমধ্যে এ ইস্যুতে অ্যাকশনে নেমে গেছে সরকার । বিভিন্ন জায়গায় হেফাজতে নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার পাশাপাশি হচ্ছে তালিকাও। মোদির আগমনকে ঘিরে যে হরতাল-সংঘাত হয়েছে , সেসবে উসকানিদাতাদের ধরে ধরে আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি করা হবে। চিরুনি অভিযানেরও আভাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত এবং ক্ষুব্ধ হেফাজত। অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তায় ভর করেছে সংগঠনটির বেশিরভাগ নেতার ওপর। একটি অংশ সরকারের সঙ্গে আপস না করে ‘লড়ে যাওয়ার’ পক্ষে। আরেকটি অংশ চায়, ভেবে-চিন্তে পথ চলতে। তাদের টার্গেট; সরকার এবং বিরোধী—উভয়পক্ষের সঙ্গে সখ্য রেখে হাজার হাজার কওমি মাদরাসা হস্তক্ষেপমুক্ত রাখা। রাজনীতির মাঠে লড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে মসজিদ-মাদরাসা আর খানকাহ রক্ষায় সচেষ্ট এই পক্ষ।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে হেফাজতের বিরোধিতাকে ঘিরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের এই মুখোমুখি অবস্থান সংঘাতে রূপ নিয়েছে। মোদির বিরোধিতায় প্রথমে ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভে সহিংসতা হয়, তার জেরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাণঘাতী সংঘাত হয়। যার জেরে ২৮ মার্চ হরতাল ডাকে হেফাজত, ওই হরতালকে ঘিরে চরম নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয় সারাদেশে। সর্বশেষ হেফাজত নেতা মুহাম্মাদ মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ড ও তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং শিশুবক্তা খ্যাত রফিকুল ইসলামের গ্রেফতারে আওয়ামী লীগ-হেফাজতের নেতিবাচক সম্পর্কে তুষ ছড়িয়েছে।
ক্ষমতাসীন নেতারা বলছেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম থেকে যে সম্পর্ক, সেটিকে আরও সুদৃঢ় করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দুই দেশ নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষা, দ্বিপাক্ষিক ইস্যুর সমাধান ও বাণিজ্য বাড়াতে নানামুখী তৎপরতাও চালাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে করোনা মহামারি সত্ত্বেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ প্রতিবেশী পাঁচ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে জাঁকালো আয়োজন করেছে সরকার। আওয়ামী লীগ মনে করছে, এতে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ নিয়ে জলঘোলাকারীদের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে, প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতাকারী হেফাজত নেতাদের দাবি, মোদি সাম্প্রদায়িক নেতা। ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের জন্য তিনি দায়ী। এ ইস্যুতে নানা সময়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশও করেছে হেফাজত। মূলত এই বিক্ষোভকে ঘিরেই পরিস্থিতি সংঘাতমূলক হয়েছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজত নিকট অতীতে আওয়ামী লীগের মিত্র শক্তি হিসেবেই কাজ করেছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের সখ্য সবার জানা। শফীর জীবদ্দশায়ও মাঝে মধ্যে এই সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। আবার উন্নতিও হয়েছে। শফীর মৃত্যুর পর সম্পর্কের টানাপোড়েন বেশ প্রতিভাত হয়েছে। রাজনীতির মাঠে হেফাজত নানা সময়ে নানাজনের কাছে ব্যবহার হয়েছে। বিগড়ে গেলে নিয়ন্ত্রণে আনতে ‘একটু এদিক-সেদিক’ করতে হয়। এখন সেই পরিস্থিতিতেই পড়েছে তারা। হেফাজতের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘আদর্শিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ-হেফাজতের অবস্থান দুই মেরুতে। আওয়ামী লীগের যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। তেমনি হেফাজতও তাদের ধর্মীয় অবস্থান থেকে সরে আসতে চায় না।’
‘তবে, হেফাজত যেহেতু নিজেদের রাজনৈতিক দল দাবি করে না, আমরাও তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভাবছি না। সরকারে থাকার কারণে জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। হেফাজত তথা দেশের কওমি মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও তারই অংশ। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার সে দায়িত্ব পালন করবে। পাশাপাশি সম্প্রতি যারা সহিংসতা উসকে দিয়েছে, তাদেরও কঠোরভাবে দমন করবে। সারাদেশে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
সরকারপক্ষের দাবি, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যে পরিবেশে থেকে এবং যে শিক্ষা নিয়ে বড় হয়; সেখান থেকে দিনের পর দিন হেফাজতেই ভিড়বে, আর বিপথগামীই হবে। তাদের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও যুগোপযোগী কারিকুলাম দিতে হবে। তাতে ওই সব শিক্ষার্থীর চোখ খুলবে, তারা দেশ ও বিশ্বকে জানবে। দেশপ্রেম তৈরি হবে, ঘুচবে বর্তমান অন্ধত্ব।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যে কওমি মাদরাসার ছাত্রগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে তাদের সনদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাদের `আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ নামে সমন্বিত শিক্ষাবোর্ডও করে দেয়া হয়েছে। এই বোর্ডের অধীন কওমি মাদরাসার শিক্ষাস্তর ও কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। একটি যুগোপযোগী কারিকুলামও করে দিতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
অপরদিকে, ঢাকার বায়তুল মোকাররম, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাণঘাতী সংঘাতের ঘটনায় সম্পৃক্ত ও উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। এসব ঘটনায় ইতোমধ্যে একাধিক মামলাও হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উসকানিদাতাদের তালিকা প্রস্তুত করে এদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার নির্দেশ দিয়েছেন’। গত ৭ এপ্রিল তিনি বলেন, ‘যারা দেশব্যাপী তাণ্ডব চালিয়েছে বা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের সতর্ক করছি। দেশের জনগণের ধৈর্য ও সহনশীলতার একটা সীমা আছে। সীমা অতিক্রম করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা সারাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নানা কৌশলে মোকাবিলা করেছি। বেশিরভাগ এলাকায় এখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আছে। সম্প্রতি ঢাকার বায়তুল মোকাররম, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, এতে আমরা ব্যথিত। সাম্প্রদায়িক শক্তি আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নেতাদের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করেছে। কার্যালয় ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দিয়েছে সরকারি বহু নথি। এগুলা সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এগুলো কঠোর হস্তে দমন করা। ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
জানা গেছে, আকস্মিক সৃষ্ট এ পরিস্থিতি সামলাতে সক্ষম নয় হেফাজত। সংগঠনটির বেশিরভাগ নেতাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেজন্য তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। যে কারণে এ বিষয়ে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা এখনই মুখ খুলছেন না। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানা গেছে। তবে হেফাজত নেতারা কওমি মাদরাসায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ চান না, চান না মামলায় ফাঁসতেও।
এ বিষয়ে হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আতাউল্লাহ বলেন, ‘হেফাজত দ্বীনি আন্দোলন করে। কোনো সরকারের বিরোধিতা করে না। হেফাজত কোনো দলকে সরকার থেকে নামানোর জন্য বা কোনো দলকে সরকারে বসানোর জন্য আন্দোলন করে না। আমাদের আন্দোলন ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে। সরকার হয়তো বুঝতে ভুল করে, এজন্য অনেক সময় আমাদের বিরুদ্ধে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেকে আহত, অনেক নিহত হয়েছে। অনেকে জেলে আছে। অনেক মাদরাসায় গিয়ে হুমকি দেয়া হচ্ছে। এসব নিয়ে ১১ এপ্রিল বৈঠক আছে। সেখানে আমরা করণীয় ঠিক করবো, ইনশাআল্লাহ।’
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুইপক্ষ তৈরি হয়েছে হেফাজতে। অবশ্য এমন দুইপক্ষ আল্লামা শফীর জীবদ্দশায়ও ছিল। সেটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশ্য হয়েছে। সেসময় হেফাজতে ভাঙনের সুরও শোনা গিয়েছিল। এখন আবার সে পক্ষটিই ভেতরে ভেতরে সক্রিয় হয়েছে। ওপরে থু থু দিলে নিজের ঘাড়ে আসে—এ চিন্তায় অনেক কথা প্রকাশ্যে না বললেও তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে চায়।
এ অংশের নেতা ওয়ালী উল্লাহ আরমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৩ সালের (হেফাজতের আত্মপ্রকাশের সময়) চেয়ে এখন পরিস্থিতি বেশ নাজুক। বর্তমান হেফাজতের অদূরদর্শী সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আলেম-ওলামা, মাদরাসা ও দ্বীনি সংগঠনগুলোকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। বিশেষ করে ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিলে মাঠে ময়দানে অপরিকল্পিত তৎপরতায় হঠাৎ আমরা কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি। সরকারও সুযোগ পেয়ে এমন আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে, যা থেকে বের হওয়া সহজসাধ্য হবে না।’
তিনি মনে করেন, ‘ওই অদূরদর্শী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে মামলায় তালিকাভুক্তদের পেরেশানি। আলোচনার মাধ্যমে ধৈর্যসহকারে এখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি যেদিকেই যাক, কওমি শিক্ষা সংস্কার করে ওই অঙ্গনের শিক্ষার্থীদের মূলধারায় আনতে সরকারের যে চিন্তা, সেটি বাস্তবায়ন করে এগুনোই মঙ্গল। মুখোমুখি অবস্থানে উভয়পক্ষেরই কমবেশি ক্ষতি হবে। দেশের রাজনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সে হিসাবে মঙ্গলজনক সিদ্ধান্তই সবার জন্য ভালো হবে।