দুর্নীতি নির্মূল করতে বিচার করে প্রকাশ্যে দুর্নীতিবাজদের মেরে ফেলা উচিত’ মন্তব্য করে গবেষক, ইতিহাসবিদ ও লেখক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশে সময় এসে গেছে এই ধরনের কাজীর বিচারের।’
এ সময় ইতিহাস থেকে ইরানের শাসক রেজা খানের সময়কার একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
সোমবার (০৬ জুলাই) মধ্যরাতে চ্যানেল আইতে সরাসরি সম্প্রচারিত ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক তারিকুল ইসলাম মাসুম।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রসঙ্গক্রমে আমি ইতিহাস থেকে তথ্য তুলে আনছি- ৪০ দশকের দিকে ইরানের শাসক ছিলেন রেজা খান। তখন ইরানে রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছিল। যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ শেষ হলে রেজা নিজেই পরিদর্শন করতেন। একটি রাস্তা তৈরি হয়েছিল, বড়সড় রাস্তা।’
তিনি দেখতে গেছেন, ‘প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে। তিনি ওই রাস্তা পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন সেখানে রাস্তার মাঝখান থেকে চিড় ধরে গেছে। যেমন কয়দিন আগের কাগজে দেখলাম (আমাদের দেশে) রাস্তায় কার্পেটিং করার দুই দিনের মধ্যে সব কিছু উঠে গেছে। এই কাজটি নিশ্চয়ই সরকারি কাজ, এটা বেসরকারি কাজ নয়।’
‘যাই হোক তিনি (ইরানের সাবেক শাসক রেজা খান) বললেন এটা কোন কন্ট্রাক্টর করেছে খোঁজ দাও। পরে ওই কন্ট্রাক্টরকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন নিজের প্রাসাদে। কন্ট্রাক্টর তো খুব খুশি, স্বয়ং বাদশা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রেজা খান কন্ট্রাক্টরকে তুলে নিয়ে তিন তলার ছাদে নিয়ে গেলেন। নিয়ে গিয়ে বললেন আমি তো তোমার রাস্তা দেখেছি। তুমি লাফ দিয়ে পড়বে নাকি; তোমাকে আমি ফায়ারিং স্কোয়াডে মারবো। বেচারা কন্ট্রাক্টর ভাবলো লাফ দিয়ে পড়ে যদি বেঁচে যাই। কিন্তু লাফ দিয়ে পড়ে সে বাঁচেনি। এই সমস্ত করার ফলে ইরানে দুর্নীতি হয়নি। নির্মাণ সংক্রান্ত কোনো দুর্নীতির খবর এরপরে আমরা ইতিহাসে পাইনি। তো বাংলাদেশে তেমনটা করা হয় না কেন? আমরা প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘এটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। মানুষকে বাঁচানোর জন্য, কোটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য একজন মানুষকে আমি হত্যা করতে পারি। এটা আমার দৃষ্টি ভঙ্গিতে। কারণ সেইভাবে পৃথিবী এগিয়েছে। তা না হলে পৃথিবী এগুতে পারে না। সেজন্য আমি মনে করি বাংলাদেশে সময় এসে গেছে এই ধরনের কাজীর বিচারের।’
‘পশ্চিম দুনিয়া মানবাধিকারের অনেক কথা বলবে কিন্তু আয়নায় তাদের নিজেদের মুখ দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য যদিও ইতিহাসের খাতিরে দেওয়ার নেওয়ার মধ্যে আবদ্ধ আছে। কিন্তু দুটি জগতের নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিকতার অনেক পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্য মেনে নিতে হবে।’
করোনা মহামারির এই দুর্যোগেও অনেক মানুষের নৈতিকতা জাগ্রত না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা বলি পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; এই সময়ে অন্তত মানুষকে মানুষ হওয়ার চেষ্টা থাকাটা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা হরহামেশা যে সমস্ত খবর পাই যে বাংলাদেশ বদলায়নি। এই যে গতকালও সারাদিনে একটা বড় খবর ছিল যে ময়মনসিংহে একটা ইউনিয়নে বক্স কালভার্ট তৈরি করবার সময় রডের বদলে বাঁশ দেওয়া হয়েছে। আজকে বক্স কালভার্টে তিনজন ইউপি সদস্য তাদের নাম দেওয়া হয়েছে, ছবি দেখানো হয়েছে।’
আগে একটি সরকারি কাজে রডের বদলে বাঁশ দেওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগের সেই গর্হিত কাজটির কোনো শাস্তি হয়েছে কি না আমরা জানি না। এজন্য এখন আবার এটা হয়েছে আরকি, এই ধরনের কাজ হচ্ছে। বাঁশ দেওয়া হয়েছে আবার বাঁশও দেওয়া হয়নি। শুধু শুধু ইট আর সিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। তো এগুলো কেন হয়। এগুলো তো সব জনগণের অর্থ। জনগণের অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করার জন্য সরকার বরাদ্দ করে দেয়। তারপরও এই কাজটি তৃণমূল পর্যায়ে কি করে হয়?’
জনগণের অর্থ নয়-ছয়ের বিষয়ে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমার প্রশ্নটা সেখানে যে জনগণের অর্থ নয়-ছয় হয় কি করে? এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। কথা হচ্ছে জনগণের অর্থটা নয়-ছয় হয় এই দায়িত্বটা কে নেবে? সরকারকে নিতে হবে। সরকারকে বলতে হবে এই কাজটির জন্য এই এই প্রতিষ্ঠানকে, এই এই ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হল। যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় তাহলে এই কাজ আর হবে না। ’
মানবপাচারে জড়িত একটি প্রতিষ্ঠানের পিয়নের অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি টাকা থাকার বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেখুন বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা কেমন। একজন পিয়ন তার চলতি হিসেবে ৩০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। ৩০ কোটি টাকা আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। এতদিন চাকরি করে, বিদেশে গিয়ে স্কলারশিপি নিয়ে ৩০ কোটি টাকা ভাবতেও পারি না। সমাজের ভেতরটা কিভাবে ক্ষয়ে গেছে। সেজন্যই কিন্তু বলা হয়েছে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে রাতারাতি ধনী হওয়া যায় এমন দেশের তালিকায় ৩ নম্বরে আছে বাংলাদেশ। আবার বাংলাদেশ থেকে মুদ্রা পাচারের পরিমাণও নেহাত কম নয়। সব কিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষ দুর্নীতির কারণে বা বিধি বর্হিভূত আয়ের কারণে বেশভালোই আছে। শাসনের কথাটা সামনে নিয়ে আসি।’
ড. আনোয়ার বলেন, ‘দেশ চালাতে হলে মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব কতটুকু। সাধারণত বলা হয় যে, কয়দিন আগে জহরলাল নেহেরুর আত্মজীবনী দ্বিতীয় বার পড়ছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে সরকার কম শাসন করে সে সরকার ভাল। কিন্তু বাংলাদেশ এমন একটা দেশ এখানে শাসন দরকার।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্যের কথা তুলে ধরে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন যারা হঠাৎ করে বড় লোক হয় তাদের থামাতে হবে। আর যারা দরিদ্র আছে তাদের একটু তুলতে হবে। আমার মনে হয় সেই কাজটি আমাদের করা হয়নি এখনো। করা উচিত। বড় লোক বলতে কালো টাকার বড় লোকদের বুঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সমাজটাকে দেখেই বুঝেছিলেন যে এই দেশে কি করণীয়।’