ব্যারিস্টার নাজির আহমদ: গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমালোচনা থাকবেই। থাকতে বাধ্য। একমাত্র চরম কর্তৃত্বপরায়ন বা নিষ্ঠুর একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমালোচনার কোন স্থান নেই। সেখানে থাকবে শুধুই বন্দনা আর প্রশংসা। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত রাজনীতিবিদদের ও তাদের কর্মীদের, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের সমালোচনা সহ্য করার মন ও মানসিকতা থাকতে হবে। নতুবা সুন্দর সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়েই উঠবে না বা কোন রকম গড়ে উঠলেও তা মোটেই স্থায়ীত্ব পাবে না।
রাস্ট্র ও সরকার যারা চালান তারা তো রক্ত-মাংসে মানুষ, তাঁরা ফিরিস্তা নিশ্চয়ই নন। তাছাড়া তাঁরা নবীদের মতো নির্ভুল অহী দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও নন! সুতরাং তাঁদের ভুল হবেই এবং হতে বাধ্য, কেননা মানুষ মাত্রই ভুল হয়, ভুল করে। আর ভুল হলে সমালোচনা করতেই হবে দেশের স্বার্থে, এমন কি তাঁদের (অর্থাৎ ভুলকারীদের) নিজেদের স্বার্থেও! সমালোচনা না করলে তাঁরা তাঁদের ভুল শোধরাবে কিভাবে?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমালোচনার অধিকার দিয়েছে রাস্ট্রের সর্বোচ্চ আইন তথা সংবিধান। বাক স্বাধীনতা, কথা বলার অধিকার ও সমালোচনা করার অধিকার হচ্ছে জনগণের সহজাত, মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার সব সময়ের জন্য – শান্তির সময়, এমন কি মহামারী বা চরম ক্রান্তিকালেও। এই সহজাত অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। সমালোচনা শুনে তেডে আসলে হবে না বরং সমালোচনার জবাব দেয়া উচিৎ নিজেদেরকে সংশোধন করে অথবা নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে অথবা নিজেদের কর্মতৎপরতার পক্ষে সঠিক তথ্য ও যুক্তি দিয়ে। জোর করে, ভয় দেখিয়ে, নির্যাতন করে বা মামলা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখা বা সমালোচনাকে স্তব্দ করা কোন সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
তবে হ্যাঁ, সমালোচনা হতে হবে ইতিবাচক, যৌক্তিক ও সঠিক এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে। সমালোচনায় মিথ্যা, কুৎস রটনা বা মানহানিকর কিছু থাকলে, তারও সুরাহা করতে হবে যথাযথ পদ্ধতি (Due process) অনুসরন করে নিরপেক্ষ প্রতিষ্টানের (যথা, আদালত বা স্বাধীন কমিশন) মাধ্যমে। এগুলো নিরূপনের দায়িত্ব কোন মতেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বা তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন সরকারী কর্মকর্তাদের উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাদের কাছে ছেড়ে দিলে বরং সমালোচনাকারীরা শুধুমাত্র সমালোচনার কারনে হবে নির্যাতন ও নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু। রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও সমালোচনায় দ্বিমত, ভিন্নমত ও ভিন্ন ডাইমেনশন থাকা স্বাভাবিক বিধায় এগুলোকে সব সময় রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করাই শ্রেয়। আদালতকে এগুলোতে ঠেনে এনে বিতর্কিত করা সুস্হ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের পরিপন্থি।
সমালোচনার বিপরীতে আছে একমাত্র ভালোচনা আর শুধু গুনগান ও প্রশংসা। ইতিহাস সাক্ষী এগুলো মোটেই সঠিক নয়। খয়েঁর খাঁর মত শুধু বন্দনা আর প্রশংসার স্তুতি করতে থাকলে ক্ষমতাসীনরা জানতেই পারবেনা বা ঠেরই পাবে না তাঁরা কোথায় কোথায় ভুল করছেন! আর এটি তাঁদের নিজের জন্য এবং দেশের জন্য এক সময় মারাত্মক পরিনতি নিয়ে আসবে যা কল্পনাতীত। তাই সমালোচনা রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাসীনদের জন্য অলংকার স্বরূপ যা তাদেরকে সঠিক পথে বা ট্রাকে রাখতে সাহায্য করে।
আমরা যারা গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে মেইনস্ট্রিম রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তারা তো অহরহ বৃটিশ সরকারের, বিশেষ করে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কঠোর ভাষায় সমালোচনা করি ও করছি। কৈ, আমাদেরকে তো কেউ বারণ করছে না, অসুবিধা হওয়া তো দুরের কথা। এটাই সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা। যেমন ধরুন চলমান বিশ্বব্যাপী মহামারীতেও ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে বিরোধীদল লেবার পার্টি যথাযথ গঠনমূলক সমালোচনা করছে পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্টের বাহিরে উভয় জায়গায়।
অনেক সময় ক্ষমতাসীনরা ভাবেন সমালোচনা শুধুই আমাদের ব্যাপারে কেন? অথচ তাঁরা ভুলে যান যে – ক্ষমতায় যারা থাকেন সমালোচনা তো তাদেরই হবে। যারা ক্ষমতায় নেই তাদের সমালোচনা করে লাভ কি? তাদের কিইবা করার আছে! রাস্ট্রীয় ক্ষমতা, শক্তি ও প্রটোকল তো তাদের নেই। তাই উন্নত গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে। আর সেই বিরোধী দলের কাজই থাকে সরকারের সমালোচনা করা এবং সাথে সাথে জনগণের সামনে তাদের বিকল্প উপায় বা কর্মপন্থা উপস্থাপন করা। সুন্দর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় “সরকারী দল” ও “বিরোধী দল”কে তুলনা করা হয় দ্বি-চক্র (দুই চাকার) যানের সাথে যার একটি চাকা অচল হলে পুরো যানই বিকল হয়ে যায়।
লেখক: বিলেতে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, বিশ্লেষক, রাস্ট্রচিন্তক ও লন্ডনের নিউহ্যাম বারার ডেপুটি স্পিকার।