বিএনপির কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এমন খবরে দেশজুড়ে বিশেষত বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে উৎসাহ ও স্বস্তি বিরাজ করছে। তবে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফিরলেও বিধি-নিষেধের আওতায় থাকতে হবে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে।
মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর গুলশানের নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি জানান, ‘খালেদা জিয়ার জামিন সংক্রান্ত সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটা দরখাস্ত ও আইন মন্ত্রণালয়ে একটা দরখাস্ত করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়ার জন্য। আবেদনে অবশ্য বলা হয়েছিল, উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর জন্য। এরপরে বেগম খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ঈস্কানদার, তার বোন সেলিমা ইসলাাম এবং তার বোনের স্বামী রফিকুল ইসলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে একই বিষয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং সেখানেও এ আবেদনের ব্যাপারে তারা কথা বলেছিলেন। মাননীয় প্রধানন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, নির্বাহী আদেশে তাঁকে (খালেদা জিয়া) মুক্তির দেয়ার। এর প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারায় বেগম খালেদা জিয়ার সাজা ছয় (০৬) মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে ঢাকাস্থ নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ এবং উক্ত সময়ে দেশের বাইরে গমন না করার শর্তে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই মতামত এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে (খালেদা জিয়া) এই দুই শর্তসাপেক্ষে দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য।’
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে কিন্তু বলা হচ্ছে না তিনি হাসপাতালে গিয়ে তার চিকিৎসা নিতে পারবেন না। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে তার কন্ডিশনের ওপরে দেখা যাবে। সেজন্য কথাটা উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। বেগম খালেদা জিয়ার বয়স বিবেচনায়, মানবিক কারণে সরকার সদয় হয়ে দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে তাকে (খালেদা জিয়া) ভর্তি হতে হবে সেটা অবস্থার প্রেক্ষিতে বোঝা যাবে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে তিনি ঢাকাস্থ নিজ বাসায় থেকে তার চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। এবং উক্ত সময়ে তিনি দেশের বাইরে গমন করতে পারবেন না।’
আইনমন্ত্রীর ভাষ্যমতে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রধান দুটি শর্ত হলো:
১. খালেদা জিয়াকে নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
২. ওই সময়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় বলা আছে, ‘কোনও ব্যক্তি কোনও অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যেকোনও সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয় সেই শর্তে তার দণ্ড স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশ বিশেষ মওকুফ করতে পারবেন।’
সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় খালেদা জিয়া পূর্ণ পুলিশি নিরাপত্তায় থাকবেন কিনা জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ব্রেকিংনিউজকে জানান, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় পুলিশি নিরাপত্তার কোনও বিধান আইনে নেই। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তার (খালেদা জিয়া) জন্য পুলিশি নিরাপত্তা রাখা হবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ১ উপধারায় আসামিদের দণ্ড স্থগিতের বিষয়ে সরকারকে ক্ষমতা দেয়া হলেও পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো একই ধারার ২, ৩, ৪, ৪ (ক), ৫, ৫ (ক) এবং ৬ উপধারায় বর্ণিত হয়েছে।
এরমধ্যে ‘৪০১ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, যখন কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয় তখন যে আদালত ওই দণ্ড দিয়েছিলেন বা অনুমোদন করেছিলেন সেই আদালতের প্রিজাইডিং জজকে সরকার ওই আবেদন মঞ্জুর করা কিংবা মঞ্জুর করতে অস্বীকার করা উচিত কিনা, সে সম্পর্কে তার মতামত ও মতামতের কারণ বিবৃত করতে এবং এই বিবৃতির সঙ্গে বিচারের নথির নকল অথবা যে নথি বর্তমানে আছে সেই নথির নকল পাঠানোর নির্দেশ দেবেন।
ফলে ৪০১ ধারার ২ উপধারা অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার বিষয়টি আদালতকে জানাবেন সরকার।
আবার, ৪০১ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, যেসব শর্তে কোনও দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হয়েছে তার কোনোটি পালন করা হয়নি বলে মনে করলে সরকার স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করবেন এবং অতঃপর যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হয়েছিল সে মুক্ত থাকলে যেকোনও পুলিশ অফিসার তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন এবং তার দণ্ডের অনতিবাহিত অংশ ভোগ করার জন্য তাকে জেলে পাঠানো যাবে।
এই উপধারা অনুযায়ী সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির ক্ষেত্রে যে দুটি শর্ত দিয়েছে তা যথাযথ পালন করা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজরদারি করবে। শর্ত ভঙ্গ হলে বিনা পরোয়ানায় তাকে গ্রেফতারের সুযোগ থাকছে সরকারের হাতে। সেক্ষেত্রে সাজার বাকি অংশ ভোগ করানোর জন্য তাকে কারাগারে পাঠাতে পারবে সরকার।
একই ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়েছে, যেই শর্তে এই ধারার অধীন দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়, দণ্ডিত ব্যক্তি সেই শর্ত পূরণ করবে অথবা শর্ত এমন হবে, যা পূরণে সে স্বাধীন থাকবে।’
এই উপধারার (৪ক) অংশে আরও বলা হয়েছে, এই বিধি বা অন্য কোনও আইনের কোনও ধারা অনুসারে কোনও ফৌজদারি আদালত কোনও আদেশ দিলে তা যদি কোনও ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে অথবা তার বা তার সম্পত্তির ওপর দায় আরোপ করে তাহলে উপযুক্ত উপধারাসমূহের বিধান এ আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।’
ধারাটির ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা প্রদর্শন, দণ্ড স্থগিত রাখা বা কার্যকর করায় বিলম্ব ঘটানো বা মওকুফ করার অধিকারে এ ধারার কোনও কিছু হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে করা যাবে না।
এই উপধারার (৫ক) অংশে আরও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি কোনও শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা মঞ্জুর করলে ওই শর্ত যে প্রকৃতিরই হোক না কেন তা এই আইন অনুসারে কোনও উপযুক্ত আদালতের দণ্ড দ্বারা আরোপিত শর্ত বলে গণ্য হবে এবং সে অনুযায়ী বলবৎযোগ্য হবে।
এবং ৪০১ ধারার ৬ উপধারা অনুযায়ী, সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলি সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারবেন।
উল্লেখ্য, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট- এই দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাভোগ করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এর মধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গেল বছরের এপ্রিলে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে গত প্রায় ১১ মাস ধরে সেখানেই কারা নজরদারিতে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি।
এদিকে সারা দেশে যখন করোনা ভাইরাস নিয়ে জনমনে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ঠিক এমন সময়ে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তাতে করে দেশবাসীর মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে বলে গতকাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।