আমদানি-রফতানির আড়ালে গত প্রায় ১০ বছরে ১১৫১ কোটি ডলার বা ৯৮ হাজার কোটি টাকা পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে করা আমদানি-রফতানি পণ্যের প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দেখানোর মূল্যের ব্যবধান বিবেচনায় এতথ্য পেয়েছে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থাটি মঙ্গলবার (৩ ফেব্রুয়ারি) এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘১৩৫ উন্নয়নশীল দেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত অর্থপাচার : ২০০৮-২০১৭’ শিরোনামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশ ও ৩৬টি উন্নত দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭০টি দেশের সঙ্গে আমদানি-রফতানি করছে। এসব দেশ থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যমূল্য ও এসব দেশে বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা পণ্যমূল্য এবং ওইসব পণ্যের প্রকৃত মূল্যের ফারাক বের করে এ তথ্য জানিয়েছে।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আমদানি-রফতানির ২২ হাজার ৯৫০টি তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটি। জিএফআইয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশ যে পরিমাণ আমদানি-রফতানি করেছে, তার সঙ্গে বিশ্ববাজারে ওইসব পণ্যমূল্যের ব্যবধান ২০১৫ সালে ছিল ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর ১০ বছরের গড় হিসাবে এর হার ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাংলাদেশ ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে, আমদানি করেছে ৪৪ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ গত অর্থবছর ৮৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ মূল্য গোপন করে পাচার হলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি প্রায় ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা।
২০০৮ থেকে ২০১৭ সময় পর্যন্ত ১০ বছরের তথ্য ধরে প্রতিবেদনটি করা হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য পায়নি জিএফআই। তবে বাকি সাত বছরে গড়ে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি পণ্যমূল্যের সঙ্গে প্রকৃত মূল্যের ব্যবধান ৭৫৩ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮ সালের পরে বাংলাদেশে এভাবে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে। ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৪৯০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৭০৯ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮০০ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭১২ কোটি ডলার ও ২০১৩ সালে ৮৮২ কোটি ডলার বিদেশে গেছে।
টাকার অঙ্কে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় চীন থেকে, যার পরিমাণ ৩২৩ বিলিয়ন ডলার। পরের অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো, রাশিয়া, পোল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। আর শতকরা হিসাবে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া থেকে, যার পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। পরের তালিকায় রয়েছে টোগো, মালদ্বীপ, মালাউ ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জ।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী—প্রায় সবার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁরা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় কোনো আস্থা নেই।
তিনি আরও বলেন, সুশাসন না থাকলে টাকা পাচার হবেই। টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িতরা সমাজের উঁচু স্তরের লোক। দেশে টাকা ধরে রাখার জন্য তাঁদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। সবার আগে দেশকে ভালো করতে হবে।