ছাত্রলীগের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে
১১১টি সাংগঠনিক ইউনিটের ১০৬টিই মেয়াদোত্তীর্ণ * মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের চাপ এড়াতে কমিটি গঠনে নেই কার্যকর উদ্যোগ
রেজাউল করিম প্লাবন: ঝিমিয়ে পড়েছে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। এ মুহূর্তে সংগঠনটির ১১১টি সাংগঠনিক জেলার ১০৬টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এর মধ্যে ৩৫টি প্রায় ৪-৫ বছর ও ৭১টি ২-৩ বছরের পুরনো। সম্প্রতি বিলুপ্ত করা হয়েছে এসব কমিটিও।
শুধু তাই নয়, জেলাগুলোর অন্তর্গত উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডেও নেই কোনো বৈধ কমিটি। এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটির বিতর্কিত ২২ নেতাকে আড়াই মাস আগে সরিয়ে দেয়া হলেও অদ্যাবধি পূরণ হয়নি সেই পদগুলো। এখানেই শেষ নয়, ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয়ও কমিটি নেই দীর্ঘদিন।
নতুন করে এসব কমিটি গঠনে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও পিছু হটেছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের নানা ধরনের চাপের মুখে থেমে যায় তাদের সব উদ্যোগ।
এমন অবস্থায় কমিটি গঠন করা হলে ওইসব প্রভাবশালীর রোষানলে পড়াসহ বিতর্কিত হতে পারেন- এমন আশঙ্কা থেকেই মূলত কমিটি গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না নেতারা।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। নেতাদের অভিযোগ- বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রাচীন ও দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান রাখা ছাত্র সংগঠনটির ‘চেইন অব কমান্ড’ একরকম ভেঙে পড়ছে।
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মূল দায়িত্বই ছিল- সারা দেশ সফর করে সাংগঠনিক জেলাগুলোর সম্মেলনের আয়োজন ও নতুন কমিটি গঠন। কিন্তু দায়িত্ব পাওয়ার পর ছয় মাস অতিবাহিত হলেও মাত্র তিনটি জেলা কমিটি গঠন করেছেন তারা।
এ ছাড়া দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের। এভাবে চলতে থাকলে কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদের বাকি পাঁচ মাস পর বড় ব্যর্থতা নিয়ে বিদায় নিতে হবে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংগঠনটির কোনো কোনো নেতা।
‘কমিটি না হওয়ার ব্যর্থতার দায়ভার তাদের নয়’- এমন মন্তব্য করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য সোমবার যুগান্তরকে টেলিফোনে বলেন, আমরা দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র কয়েক মাস। এর মধ্যে সবকিছু করা সম্ভব না।
ইতিমধ্যে আমরা তিনটি জেলার সম্মেলন করে কমিটি দিয়েছি। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, দ্রুত অন্যান্য জেলায়ও সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি উপহার দিতে পারব। সংগঠন তার নিজস্ব গতিতেই চলছে বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সমন্বয়কারী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক যুগান্তরকে বলেন, এখনও সময় আছে। মার্চ পার হলেই পুরোদমে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করবে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দু’বছর এবং জেলাসহ অন্যান্য শাখা কমিটির মেয়াদ এক বছর। ২০১৮ সালের ১১-১২ মে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সম্মেলনের আড়াই মাস পর ৩১ জুলাই সভাপতির পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম রাব্বানীর নাম ঘোষণা করা হয়। চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর শোভন-রাব্বানীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেদিনই কমিটির এক নম্বর সহসভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জয় ও লেখককে ভারমুক্ত করে পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দায়িত্বের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও সাংগঠনিক কাজে গতি ফেরাতে পারেননি তারা। এ নিয়ে সংগঠনটির নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
ছাত্রলীগের দফতর সূত্রে জানা গেছে, সংগঠন থেকে অব্যাহতি পাওয়া শোভন-রাব্বানী ১৩ মাসে মাত্র ২টি (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) সাংগঠনিক জেলার কমিটি দিতে পেরেছেন।
বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ১১ মাসে পুরো সংগঠন ঢেলে সাজানোর কথা থাকলেও ছয় মাসে নতুন করে কমিটি দিয়েছেন মাত্র তিনটি জেলায় (চাঁদপুর, নড়াইল ও কিশোরগঞ্জ)। বাকি ১০৬টি সাংগঠনিক জেলার কমিটি করতে হবে মাত্র ৫ মাসে! এ তিনটি কমিটি নিয়েও আছে নানা বিতর্ক।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১১ নভেম্বর কুড়িগ্রাম জেলা কমিটি ভেঙে দেয় জয়-লেখক। সেখানে কোনো আহ্বায়ক কমিটি না দেয়ায় এখন কমিটিবিহীন জেলা ছাত্রলীগ। শুধু তাই নয়, জেলার ৯টি উপজেলায়ও নেই ছাত্রলীগের কমিটি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জেলার চিলমারী উপজেলা কমিটিও বিলুপ্তি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। চাঁদাবাজির মামলায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম মিয়া গ্রেফতার হলে তার রেশ গিয়ে পড়ে পুরো কমিটির ওপর। একই অবস্থা ছাত্রলীগের অন্য জেলা শাখাগুলোর মধ্যে।
কোথাও নতুন নেতৃত্ব নেই। ঠুনকো অজুহাতে কেন্দ্র থেকেও উপজেলা কমিটি ভেঙে দেয়া হচ্ছে। কমিটি গঠনে আগ্রহী প্রার্থীদের কাছে জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হলেও তা ফাইলবন্দি থাকছে। কমিটি গঠন, ভাঙনে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের স্বার্থের চেয়ে এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের স্বার্থই বেশি বাস্তবায়ন করা হয় বলেও জানায় সূত্রটি।
ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না ছাত্রদল
১১৭ ইউনিটের বেশিরভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ * পুনর্গঠনে ১০ বিভাগীয় টিম
হাবিবুর রহমান খান
কাউন্সিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি ছাত্রদলে। বিএনপির ‘ভ্যানগার্ড’খ্যাত এ সংগঠনটির কার্যক্রম অনেকটাই মন্থর। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনসহ জনগুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতেই রাজপথে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ সংগঠনটি।
একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোনো ইউনিটকে রাজপথে দেখা যায় না। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতাদের বয়স সারা দেশের ইউনিট নেতাদের চেয়ে কম। ফলে জেলা ও মহানগর নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ অনেক ক্ষেত্রেই মানছেন না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ‘চেইন অব কমান্ড’ নেই বললেই চলে।
জানা গেছে, সারা দেশে ১১৭টি ইউনিটের বেশিরভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর এখনও কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়।
বর্তমান কমিটি দায়িত্ব নেয়ার প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে পেরেছে। তবে আরও কয়েকটি ইউনিটের নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ‘পকেট’ কমিটি গঠনের অভিযোগ ওঠায় সেগুলোও বাদ দেয়া হয়।
ছাত্রদলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, সংগঠনে গতি ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারা দেশে ছাত্রদলকে ঢেলে সাজাতে ১০টি বিভাগীয় টিম গঠন করা হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় সহসভাপতির নেতৃত্বে গঠিত প্রতিটি টিমে চারজন করে সদস্য রয়েছেন।
এর মধ্যে আছেন একজন যুগ্ম সম্পাদক, একজন সহ-সাধারণ সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। ঢাকা বিভাগে দুটি সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে। একটি ঢাকা মহানগরীর ইউনিটসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
অন্য টিমটি মহানগরের বাইরে বিভাগের অধীনস্থ জেলাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা মাঠের চিত্র তুলে আনছে। এরপর সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হবে।
জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, তৃণমূলে ছাত্রদলকে শক্তিশালী করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত দশটি সাংগঠনিক টিম ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছে।
তারা প্রতিটি জেলার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে কেন্দ্রে সার্বিক চিত্র তুলে ধরবে। এরপর আমরা নতুন কমিটি করব। যারা যোগ্য এবং ত্যাগী তাদেরই কমিটিতে রাখা হবে।
তিনি বলেন, ছাত্রদলের অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করণীয় আমরা তা করব। আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে ছাত্রদল রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। আমরা সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
১৯৯২ সালে সরাসরি ভোটে রুহুল কবির রিজভী ছাত্রদলের সভাপতি ও ইলিয়াস আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু ভোটে নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে ওঠে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দিতে বাধ্য করে ওই সিন্ডিকেট।
এরপর দীর্ঘ ২৭ বছর ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই ছিল ছাত্রদল। অযোগ্য, নিষ্ক্রিয় ও তাদের আস্থাভাজনদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়েছে যাতে সংগঠনটি নিজেদের কব্জায় থাকে। এর ফলে যোগ্য ও সাহসী নেতাকর্মীরা ছাত্রদলের রাজনীতি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
সিন্ডিকেটে আবদ্ধ থাকায় ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটি দিন দিন তাদের ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে। রাজপথে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদল এক সময় দলের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে হিমশিম খেতে হয় বিএনপির হাইকমান্ডকে।
এমন পরিস্থিতিতে সংগঠনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির হাইকমান্ড। নানা নাটকীয়তার পর সরাসরি ভোটে ছাত্রদলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের ষষ্ঠ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেন কাউন্সিলররা।
ভোটে নেতা নির্বাচিত হওয়ায় ছাত্রদলসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব লক্ষ করা যায়। সবার প্রত্যাশা ছিল- ছাত্রদল এবার তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও সেই আশায় প্রহর গুনতে থাকেন; কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর এখনও প্রত্যাশিত সফলতা দেখাতে পারেনি নতুন নেতৃত্ব।
বর্তমান কমিটির একমাত্র সফলতা দীর্ঘদিন পর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে পারছে। তবে কাউন্সিলরের ভোটে নির্বাচিত হলেও এখনও তারা সিন্ডিকেটমুক্ত হতে পারেনি। নতুন সিন্ডিকেটের কব্জায় তারা। দায়িত্ব নেয়ার পর কয়েকটি ইউনিটের কমিটি করতে গিয়ে সিন্ডিকেটের সেই প্রভাব লক্ষ করা যায়।
যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে ‘পকেট’ কমিটি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে বিষয়টি লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানকে অবহিত করা হয়। তিনি এসব কমিটি না করতে নির্দেশ দেন। তারেক রহমানের নির্দেশে ১০টি বিভাগীয় টিম গঠন করা হয়।
জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল যুগান্তরকে বলেন, সংগঠনে গতি ফেরাতে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে ১০টি বিভাগীয় টিম গঠন করা হয়েছে। তারা সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। এরপর আমরা প্রতিটি ইউনিটে নতুন কমিটি গঠন করব।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমরা তৃণমূলের দিকে বেশি নজর দিচ্ছি। যেসব উপজেলা, পৌর ও কলেজগুলোয় দীর্ঘদিন কমিটি হচ্ছে না, সেখানে আগে নতুন কমিটি করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা, মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় হাত দেয়া হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সব ইউনিটের নতুন কমিটি গঠনের কাজ শেষ করা হবে। এরপর ছাত্রদল ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করি।
জানা গেছে, ক্যাম্পাসনির্ভর রাজনীতির দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ছাত্রদল পুনর্গঠনের নির্দেশ দেয় হাইকমান্ড। কিন্তু সেখানেও বর্তমান নেতৃত্ব প্রত্যাশিত সফলতা দেখাতে পারেনি। একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এই ইউনিটটিই সক্রিয় রয়েছে।
প্রায় প্রতিদিন তারা ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ করছে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সোচ্চার এই ইউনিট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শেকৃবি, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমের কমিটি গঠনে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ আন্দোলন-সংগ্রামে এসব ইউনিটেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম রাকিব যুগান্তরকে বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা ক্যাম্পাসে অবস্থান করছি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমরা সোচ্চার আছি।
তিনি বলেন, তিন মাসের মধ্যে আমাদের সব হল কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমরা কেন্দ্রের সেই নির্দেশে কাজ করছি। বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যেই আমরা সব হল কমিটি গঠন করতে পারব বলে আশা করি।
বাম সংগঠনগুলোর নাম আছে কাজ নেই
মাহমুদুল হাসান নয়ন
জৌলুস হারিয়েছে ছাত্র ইউনিয়নসহ এক সময়ের প্রভাবশালী বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। সাংগঠনিক অদক্ষতা, সঠিক কর্মকৌশলের অভাব, ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিতে নিয়মিত সক্রিয় ভূমিকা না থাকায় অতীত অর্জন ধরে রাখতে পারছে না এসব সংগঠন।
এতে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সাধারণ ছাত্রদের থেকে। পাশাপাশি মতপার্থক্যে সৃষ্ট অনৈক্যে ভাঙন ধরেছে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনে।
বাম সংগঠনগুলো প্রত্যাশিত ভূমিকায় না থাকা এবং ছাত্রদলের দীর্ষ সময়ের নিষ্ক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে নতুন সংগঠন ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’। ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছাত্র সংগঠন রয়েছে ১৩টি। এগুলো হল- ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের দুই অংশ, জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের দুই অংশ, ছাত্র ফেডারেশনের দুই অংশ, ছাত্রমৈত্রী, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় ছাত্রদল।
এর মধ্যে প্রথম দুটি ছাড়া বাকি সবগুলোই বাম ধারার ছাত্র সংগঠন। আবার এদের মধ্যে চার সংগঠন মিলে গঠিত হয়েছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। ছাত্র ফেডারেশন এক সময় এ জোটের অংশ থাকলেও গত ডাকসু নির্বাচনে জোটবদ্ধ না হয়ে আলাদা প্যানেল করে তারা। ফলে জোটে ফেডারেশনের সদস্যপদ স্থগিত রয়েছে বলে জানান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাম ছাত্র সংগঠনগুলো অনেক আগেই এককভাবে বড় আন্দোলনের সামর্থ্য হারিয়েছে। নিয়মিত সাংগঠনিক কর্মসূচি পরিচালনা করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে, কর্মীর অভাবে দেশের বেশিরভাগ ইউনিটে নতুন কমিটি দিতে পারছে না তাদের অনেকেই।
শুধু জেলা শহরেই নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতেও কমিটি দিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। আর ক্যাম্পাসের হলগুলোতে অধিকাংশ বাম ছাত্র সংগঠনের কমিটি গঠন অনেকটা স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে।
এর ফলে ছাত্র সংসদগুলোতে দাপটের সঙ্গে নেতৃত্বদানকারী এ সংগঠনগুলো এবারের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এককভাবে কোনো প্যানেল দিতে পারেনি। প্রায় এক ডজন সংগঠন জোটবদ্ধ হয়েও সব হলে প্রার্থী দিতে পারেনি।
এদিকে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর এমন দৈন্যদশা ও ছাত্রদলের দীর্ঘ সময়ের নিষ্ক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে মূলত একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরে তারা সংগঠনে রূপ নেয়।
ছাত্রদের অধিকার সংশ্লিষ্ট কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তাদের। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।
জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত বিতর্কিত ডাকসু নির্বাচনেও ছাত্রলীগ সভাপতিকে হারিয়ে তাদের প্যানেল থেকে ভিপি পদে জয়লাভ করে। এভাবে তারা ছাত্র রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ও ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’র বাইরে বেশ কিছু সংগঠন ও জোটকে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোট, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর জোট এবং ইসলামী ছাত্র সংগঠনও।
এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র জোট, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ দলীয় ব্যানারের বাইরে গিয়ে ছাত্রদের নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন এ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠন হয়েও এককভাবে প্যানেল দেয়।
জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা এ নির্বাচনে লক্ষ্য করা যায়নি। এর বাইরে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরিরকে বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসগুলোতে পোস্টারিং ও অনলাইন প্রচারণায় দেখা যায়।
ছাত্র ইউনিয়ন, ফ্রন্টের দুই অংশ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী নিয়ে গঠিত হয়েছে প্রগতিশলী ছাত্রজোট। এ জোটের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ মাকর্সবাদী) সভাপতি মাসুদ রানা। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আসলে সময়ের একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে।
এটা মানতেই হবে। সেভাবে আমাদের ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। আগে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তরুণ সমাজ যেভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, তাও আগের মতো নেই। রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদী মনন তৈরির এ আয়োজন তার জন্য অন্যতম দায়ী।
তিনি আরও বলেন, বামপন্থী রাজনীতির যে জৌলুস সেটা এখন নেই। আগের যেই লড়াই-সংগ্রাম সেটিও হয়তো নেই। এর জন্য বামপন্থীদের রাজনীতিক ভুল সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে বামদের একাংশের হাত মেলানো। তবে এতকিছুর পরেও অন্যায়-শোষণের বিরুদ্ধে যতটুকু আন্দোলন আমরাই করছি।
বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর বর্তমান অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল যুগান্তরকে বলেন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর থেকে ক্যাম্পাসগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। যার ফলে ক্ষমতাসীন সংগঠন ছাড়া অন্যদের কাজ করতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
ক্যাম্পাসগুলোর হলে ক্ষমতাসীনরা সিট দেয়। ফলে শিক্ষার্থীরা থাকার জন্য হলেও ক্ষমতাসীনদের দ্বারস্ত হয়। এর ফলে আমাদের কর্মী-সমর্থক হয়তো কিছুটা কমেছে, তবে আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা এখনও রয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ডাকসু না থাকায় এবং অন্যান্য ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীনদের ভয়ে তাদের বাইরে যেতে পারছে না। তবে সাংগঠনিকভাবে বাম সংগঠনগুলো কিছুটা দুর্বল হলেও শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে এখনও আমরা সবার চেয়ে এগিয়ে।