কাতারের রাজধানী দোহাতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিনিধি তথা মার্কিন ‘শান্তিদূত’ জালমে খালিলজাদ এবং মার্কিন আক্রমণের সময়কালে আফগান প্রেসিডেন্ট মোল্লা ওমরের যিনি সহযোগী ছিলেন– সেই মোল্লা বারাদর এই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। তালেবান-মার্কিন চুক্তির সময় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় গোটা এলাকা।
ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবথেকে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের হয়তো অবসান হতে চলেছে। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী লড়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ– কোরিয়ান যুদ্ধ– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কোনটাই কিন্তু আফগানিস্তানের মতো এত দীর্ঘ হয়নি।
কাবুলে নিজেদের পছন্দসই এক সরকার টিকিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুদীর্ঘ ১৯ বছর লাগাতার লড়ে গেছে। আফগানিস্তানের ওপর ঢেলে দিয়েছে সমস্ত ধরনের মারণ বোমা– ক্ষেপণাস্ত্র। অভিযোগ রয়েছে, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারেরও। আফগানিস্তানকে পরাজিত করা দূরে থাকুক– কাবু করতেও পারেনি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। শনিবার চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে এক রকম পরাজয়ই স্বীকার করে নিল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ট্রাম্প।
আফগানিস্তানের সঙ্গে যখন চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন শাহেনশা ট্রাম্প, তখন সাক্ষী হিসাবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। আরো ছিলেন ১৯টি দেশের গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা। ‘আল্লাহ হু আকবার’ ধ্বনির মধ্যে এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করল সমগ্র বিশ্ব।
আমেরিকা আফগান যুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে আকাশ থেকে নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং এফ-১৬ সহ বিধ্বংসী বিমানবহর। তাও দেখা গেছে, মার্কিন সেনাদের মৃত্যুমিছিল। ৩ হাজারের ওপর মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে করুণভাবে নিহত হয়েছে। আর আহত? প্রায় ২১০০০।
আহত-নিহতদের মধ্যে অবশ্য কিছু মার্কিন সেনা জোটের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলির জওয়ানরাও শামিল রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ব্যবহার করেছিল ‘মাদার অফ দ্য অল বম্বস’। দুনিয়ার সবথেকে ভয়ংকর ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেও হালে পানি পায়নি যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। লেজে গোবরে হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন থেকেই আফগান থেকে পালাবার সুযোগ খুঁজছিল। আর এ দিকে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল কফিনবন্দি মার্কিন সেনাদের দেশে ফেরার মিছিল।
সবথেকে সমস্যা হচ্ছিল প্রায় ২৫ হাজার আহত ও জীবন্মৃত সৈনিকদের নিয়ে। তাদের ক্ষতিপূরণসহ বেতন ও চিকিৎসা করাতে আমেরিকার ব্যয়ের বহর বেড়েই চলেছিল। আর এই অকারণ যুদ্ধে নিহত ও আহতদের পরিসংখ্যান মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে শুধু উদ্বেগ নয়, তাদের ক্রোধের ভাষাও ক্রমেই প্রবল হচ্ছিল।
এ দিকে ঘনিয়ে আসছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর ট্রাম্পের বড় সাধ তিনি ফের হোয়াইট হাউজে ঢুকবেন। আর তাই ট্রাম্প তড়িঘড়ি এই ‘শান্তিচুক্তি’ করে বিপুল অর্থনৈতিক ও জানমালের ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টায় তালিবানদের কাছে প্রায় আত্মসমর্পণ করে বসলেন।
এমনিতেও আফগান যুদ্ধে তার দক্ষ সেনাবাহিনী মোটেই সুবিধা করতে পারছিল না। পর্যবেক্ষকদের অভিমত ছিল– প্রায় পুরো আফগানিস্তানেই কব্জা ছিল তালিবান ও মার্কিন বিরোধী মুজাহিদদের। আর রাজধানী কাবুলের কিছু অংশে মার্কিন প্রহরায় থাকতেন আফগানিস্তানের বশংবদ প্রেসিডেন্ট এবং তার মন্ত্রী ও পারিষদরা।
এখানেও কিন্তু রক্ষা নেই। প্রায়ই তালিবানরা কাবুলেও ঢুকে প্রেসিডেন্ট প্যালেসের সামনেই পাঁচতারা হোটেল কিংবা সেনা ছাউনিতে সফল হামলা চালাত। আফগানিস্তানের ওপর মার্কিন সেনা এবং তাঁবেদার আফগান সেনাদের দখল ছিল নামমাত্র।
তাই বলা যায়– আফগানিস্তান থেকে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে লেজ তুলে দৌড় দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই চির পরিচিত নীতিরই পুনরাবৃত্তি করলেন।