উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি সামনে আসে। গত কয়েকদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে উঠেছে। বক্তব্য আর পাল্টা বক্তব্য চলছে।
এর বাইরে পর্দার অন্তরালেও চলছে নানা রকম দেন দরবার। যার অনেক কিছু প্রকাশ্যে আসছে না।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে বিএনপি ও তার পরিবারের সদস্যরা আলাদাভাবে সরকারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করছেন, যাতে করে জামিন অথবা প্যারোল যেভাবেই হোক তাকে মুক্ত করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া যায়।
গত বছর ১২ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইনী প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে থেকে বিএনপি নেতারা বলে আসছেন, আইনীভাবে দলীয় নেত্রীর মুক্তি সম্ভব নয়। রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে। বিষয়টি হুমকি ধামকীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ডিসেম্বরে জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর গত তিন মাসে দৃশ্যমান কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি।
এদিকে দলের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। পরিবারের সদস্যরাও মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) গিয়ে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের বলছেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ। তাকে দ্রুত বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া দরকার। অপরদিকে সরকার গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড বলছে, তিনি আগের মতোই আছেন।
তার মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ডা. জিলন মিয়া গত সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, গত শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) তিনি খালেদা জিয়াকে দেখে এসেছেন। তার শারীরিক অবস্থা আগের মতোই আছে। জয়েন্টের ব্যথাগুলো একটু বেশি। এক বছর আগেও এরকমই ছিল। ভর্তির দিন যেমন ছিলেন, শনিবারও তেমনই দেখলাম।
সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার বিএসএমএমইউ ভিসির কাছে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, খালেদা জিয়ার দ্রুত অবনতিশীল স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো অপূরণীয় ক্ষতি এড়াতে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন। ওই চিঠিতে তিনি ভিসির কাছে অনুরোধ জানান, ভিসি যেন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেন।
তার দেওয়া ওই চিঠির পর রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনায় আসে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি। কিন্তু তিনি কীভাবে মুক্তি পেতে পারেন- জামিনে না প্যারোলে এটাই এখন মুখ্য বিষয়। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, আদালতের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। তাকে একমাত্র আদালতই মুক্তি দিতে পারে। তবে প্যারোলের বিষয়ে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে তারপরই সরকার বিষয়টি দেখবে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরাতো প্যারোলের আবেদন পাইনি। আবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে। আইনমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন।
একটি সূত্র জানায়, পরিবারের সদস্যরা যে কোনো শর্তে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে বিদেশে চিকিৎসা করাতে চাইলেও খালেদা জিয়া নিজে জামিনের বাইরে মুক্ত হতে চাচ্ছেন না। যারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, প্রত্যেকের কাছেই তিনি বলছেন, আমিতো কোনো অন্যায় করিনি। ক্ষমা চাইবো কেন? আর এ ধরণের মামলায় জামিন হচ্ছে না কেন?
অপরদিকে দলের মধ্যে একটি অংশ প্যারোলের পক্ষে থাকলেও বেশিরভাগ নেতাদের বক্তব্য, প্যারোল চাইতে হলে দোষ স্বীকার করতে হবে। সরকারের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। যেখানে ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে সরকার মামলা দিয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। সেখানে খালেদা জিয়া কীভাবে নিজের দোষা স্বীকার করে মুক্তির আবেদন করতে পারেন। এমন মানসিকতা থাকলে খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হতে পারতেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপিতে এমন কোনো নেতা নেই যিনি খালেদা জিয়ার কাছে গিয়ে বলবেন, আপনি প্যারোলে মুক্তির জন্য সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেন। এই সাহস কারও নেই। আর খালেদা জিয়া এমন নেত্রী যিনি মারা যাবেন, তবুও সরকারের সামনে মাথানত করবেন বলে মনে হয় না। সেটা করলে তিনি অনেক আগেই করতেন।
এসব আলোচনার মধ্যে মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তার জামিনের জন্য পুনরায় হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। এবার শারীরিক অসুস্থতার জন্য লন্ডনে নিয়ে চিকিৎসা করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে আবেদনে। হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের পরই পরবর্তী পদক্ষেপে যাবে তার পরিবার ও দল।
তবে দলের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, দেশনেত্রীর প্যারোলে মুক্তি চাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ তার পরিবারের ব্যাপার। তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
অপরদিকে তার বোন সেলিমা ইসলাম মঙ্গলবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে বলেছেন, আমরা হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। জামিনের আবেদন করা হয়েছে। জামিন না হলে পরে প্যারোলের বিষয়টি সামনে আসবে।
বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বাংলানিউজকে বলেন, প্যারোল শব্দটি বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ কোথাও উচ্চারণ করেনি। এই শব্দটি কোথা থেকে আবিষ্কার হলো আমরা সেটা নিয়েই বিভ্রান্তির মধ্যে আছি। কোন স্বার্থে কারা এটা বের করলো, কোন মিডিয়া আগে নিউজ করলো? কথা হলো প্যারোলের কোনো আলোচনাই হয়নি। আমরা মানবিক কারণে জামিন আবেদন করেছি। এটা জামিন পাওয়ার যোগ্য মামলা।
সরকার বলছে সর্বোচ্চ আদালত যখন তার জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছে তখন তার মুক্তির একমাত্র পথই হচ্ছে প্যারোল- সেটা নিয়েইতো আলোচনা। এ বক্তব্যের জবাবে আলাল বলেন, হ্যাঁ, সরকার বলতে পারে মুক্তির একমাত্র পথই প্যারোল। নির্বাচনে মানুষ ভোট না দিলেও ক্ষমতায় থাকার একমাত্র পথই হলো জোর। সেটা নিয়ে কি কোনো আলোচনা হচ্ছে?
তিনি বলেন, সিআরপিসিতে ৪০১ (এ) ধারায় বলা আছে কোনো আবেদন ছাড়া সরকার ইচ্ছা করলে স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে শর্তযুক্ত কিংবা শর্তহীনভাবে যেকোনো আসামির দণ্ড স্থগিত করতে পারে, দণ্ড মওকুফ করতে পারে। জামিন দিতে পারে, খালাসও দিতে পারে। সেটাতো একবারও সরকার বলে না।
সরকারতো আপনাদের প্রতিপক্ষ, সেটাতো সরকার করবে না- আপনার কী মনে হয়? তিনি বলেন, হ্যাঁ, সরকার এটা করবে না, কারণ সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার জীবনের চেয়ে তাদের রাজনীতির মূল্য বেশি। আর আমরা ওনার স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো রাজনীতি করছি না।
আপিল বিভাগতো জামিন আবেদন খারিজ করেছে, এখন আবার হাইকোর্ট বিভাগ কী জামিন দেবে? জবাবে তিনি বলেন, দিতে পারে। হাইকোর্টের দেওয়ার এখতিয়ার আছে। হাইকোর্টের অনেক মামলা ফেরত আসার পরে নিম্ন আদালত আবার জামিন দিয়েছে। আবার নিন্ম আদালত জামিন দেয়নি, হাইকোর্টও দেয়নি কিন্তু আপিল বিভাগ দিয়েছে। এরকম অনেক উল্লেখযোগ্য মামলা আছে। হাইকোর্ট ইচ্ছা করলে নতুন গ্রাউন্ড তৈরি করে দিতে পারে। আগেরবার যেহেতু আপিল বিভাগ উন্নত চিকিৎসা দিতে বলেছে। এবারের আবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে অমুক দেশে যাবেন চিকিৎসা করতে।
এবারও যদি জামিন আবেদন খারিজ হয় তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে? জবাবে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সেটা এখনই বলা যাবে না। আমরাতো আশাবাদী যে জামিন হবে।
আপনারা কী প্যারোলের বিষয়ে খালেদা জিয়ার কোনো মনোভাব জানতে পেরেছেন? জবাবে তিনি বলেন, প্যারোলের ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ গররাজি। এ কথা ওনাকে বলার কেউ সাহস করতে পারবে না। তবে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করছেন, সেটা তিনি বিনীতভাবে প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার আপনাদের দলের মহাসচিব বলেছেন, প্যারোলের বিষয়টি তার পরিবার সিদ্ধান্ত নেবে। এ ব্যাপারে পরিবারের কোনো বক্তব্য কি আপনারা জানতে পেরেছেন? আলাল বলেন, না। তবে ম্যাডামের বোন সেলিমা ইসলাম একটি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জামিনের আবেদন করা হয়েছে। সেখানে কী হয় দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তারা নেবেন। এই বিষয়টি তারাই দেখবেন। তবে আমাদের কাছে যতটুকু খবর আছে, বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে প্যারোলের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
হাইকোর্টে যে আবেদন করা হয়েছে তাতে জামিন হওয়ার ব্যাপারে আপনারা কতটা আশাবাদী। জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না। এটর্নি জেনারেল ও দুদকের আইনজীবীর বক্তব্য শোনার পরই বলা যাবে কী হতে পারে।
দুদকতো বলে দিয়েছে তারা জামিনের বিরোধীতা করবে- জবাবে আলাল বলেন, হ্যাঁ। বিরোধিতারতো অনেক কৌশল আছে। তারাতো পেশাদার আইনজীবী।