কুয়েতে মানবপাচারে হাজার কোটি টাকার কারবারে অভিযুক্ত হিসেবে সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের নাম এসেছে। দেশটির ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট সিআইডির অভিযানের মুখে বাংলাদেশের এই এমপি কুয়েত ছেড়েছেন। মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে কুয়েত সরকার সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। অভিযান নিয়ে কুয়েতের সংবাদ মাধ্যমগুলো সিরিজ রিপোর্ট করছে। সেখানে ওই এমপি ছাড়াও আরও দুজনের নাম এসেছে। বাংলাদেশ মিশন বলছে, এমপিকে নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর কুয়েত সিআইডিতে তারা তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করেছেন। সিআইডি থেকে মারাতিয়া কুয়েতি গ্রুপ অব কোম্পানীজ এর সত্বাধিকারী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি লক্ষীপুর-২ আসনের এমপি।
বিগত জাতীয় নির্বাচনে ওই আসনে ১৪ দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টির সমঝোতার মাধ্যমে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন পাপুল। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। পরে এক পর্যায়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির প্রার্থী। আলোচনা ছিল মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পাপুল ওই প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেন। বিষয়টি নির্বাচনের সময়ই বেশ আলোচিত ছিল।
বাংলাদেশ মিশনের হেড অব চ্যান্সারি মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন, মানবপাচার রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে কুয়েত।
অবৈধপথে লোক পাঠানোকেই তারা মানবপাচার বলছে। হাই কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সংসদ সদস্য পাপুল কুয়েতে নেই এটাও নিশ্চিত করেছে সিআইডি। তবে কুয়েতি সংবাদ মাধ্যমে একজন গেপ্তারের যে খবর বেরিয়েছে তার বিস্তারিত জানতে সিআইডিকে চিঠি দিয়েছেন বলেও জানান। কুয়েতি সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশি এমপির ব্যবসা পেতে বিশালবহুল গাড়ি উপহার দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ওই এমপির প্রোফাইল এবং নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামা ঘেটে দেখা যায়, নির্বাচনী হলফনামায় তিনি পেশা ‘ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বা আন্তর্জাতিক ব্যবসা দেখিয়েছেন। তার প্রোফাইল বলছে, কুয়েত ছাড়াও জর্ডান, ওমানে লোক পাঠান তিনি। কুয়েত আওয়ামী লীগের পৃষ্টপোষক দাবিদার কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল জাতীয় নির্বাচনে আপেল প্রতীকে নির্বাচন করেন।
যা বলছে কুয়েতের সংবাদ মাধ্যম: কুয়েতের প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যম আল-কাবাস বৃহস্পতিবার মানবপাচার নিয়ে তার প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে-বাংলাদেশি ওই এমপি সামপ্রতিক সময়ে কুয়েতে একজন মার্কিন বাসিন্দার সঙ্গে আর্থিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলেন। কুয়েতে আয় করা বেশিরভাগ অর্থই তিনি আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। সূত্রের বরাতে আল কাবাসের খবরে জানানো হয়- প্রাথমিক পর্যায়ে কুয়েতের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে নিজেই প্রতিষ্ঠানটির একজন অংশীদার হয়ে ওঠেন। এরপর আর তার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে শুরু করেন। ওই এমপি কুয়েতে এমন বেশকিছু টেন্ডার কেনেন, যেগুলো লাভজনক ছিল না। সেগুলো কেনার উদ্দেশ্য ছিল, চুক্তিগুলোর আওতায় কুয়েতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী নেয়া। এসব কর্মী নেয়ার মাধ্যমে আয় করা অর্থ দিয়েই ওই টেন্ডারগুলোর অর্থায়ন করতেন তিনি। অবৈধভাবে আয় করতেন ব্যাপক অর্থ। বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়ার জন্য কুয়েতে তার প্রতিষ্ঠানটি যেন সরকারি চুক্তি পায় সেজন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। আল কাবাসের প্রতিবেদনে অভিযানের মুখে কুয়েতত্যাগী সুলতান নামের অপর মানবপাচারকারীর নামে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। বলা হয়েছে, কুয়েত থেকে পালিয়ে গেলেও সুলতানের নিজের প্রতিষ্ঠানের উচ্চ-পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বিপুল অর্থের বিনিময়ে সেখানে শ্রমিক নেন। এজন্য বহু দালালের ব্যবহার করেন তিনি। এসব কর্মকাণ্ডে প্রাপ্ত অর্থ কুয়েতের বাইরে একটি ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখেন তিনি। বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, সুলতানের বিষয়ে তাদের কাছেও নেতিবাচক রিপোর্ট রয়েছে। তার বাড়ি বৃহত্তর সিলেটে। সিআাইডি যাকে আটক করার কথা বলছে সে সুলতান কি-না? সেটি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে বলে বাংলাদেশ মিশনের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, সুলতানও নাকী পালিয়েছেন। তার ইউরোপের দিকে যাওয়ার কথা ঘনিষ্ঠ মহলে প্রচার ছিলো। আল-কাবাস বলছে, তারেক নামে অপর মানবপাচারকারীর খবর প্রকাশ পেয়েছে। মিশন বলছে তার বাড়ি গাজীপুরে। তিনি অনেক দিন ধরেই কুয়েত পুলিশের হাতে আছে। তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে মর্মেও খবর বেরিয়েছিলো।
১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার কারবার: ওদিকে কুয়েতি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে- অর্থপাচার, মানবপাচার ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে বাংলাদেশি এক এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত চালু করেছে কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একই অভিযোগে অপর এক বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুয়েতের গণমাধ্যম আরবটাইমসঅনলাইন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এমনটা বলেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে কুয়েতের দৈনিক আল-কাবাস। তারা জানায়, অজ্ঞাত এক বাংলাদেশিকে অর্থ ও মানবপাচার এবং ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ গ্রেপ্তার করেছে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গ্রেপ্তার হওয়া ওই ব্যক্তি তিন ব্যক্তি নিয়ে গঠিত একটি চক্রের সদস্য ছিলেন। চক্রের বাকি দুই সদস্য কুয়েত ছেড়ে পালিয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি সমপ্রতি বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য হয়েছেন। অপর একজনকে ‘এস’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি ইউরোপে পালিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে অভিযুক্ত কারোই নাম প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদন অনুসারে, অভিযুক্তরা কুয়েতের তিনটি বড় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে গৃহকর্মী হিসেবে ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়েতে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এসব শ্রমিকদের কুয়েতে পাঠানোর বিনিময়ে ৫ কোটি কুয়েতি দিনার বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার বেশি নিয়েছেন। আরবটাইমসঅনলাইন জানায়, সবচেয়ে অশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অভিযুক্তদের একজন সমপ্রতি বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের একটি বড় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও তিনি। প্রায়ই তিনি কুয়েতে যাতায়াত করেন। তবে সেখানে কখনোই ৪৮ ঘণ্টার বেশি অবস্থান করতেন না। সূত্র জানিয়েছে, এক সপ্তাহ আগে তার বিরুদ্ধে সিআইডির তদন্ত চালু হওয়ার তথ্য জানতে পারেন তিনি। এরপর সঙ্গে সঙ্গেই কুয়েত ছাড়েন তিনি। তার প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। তিনি যে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে ছিলেন, সেটির কর্মীদের পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে কোনো বেতন দেয়া হচ্ছে না। উপরন্তু, বাংলাদেশ থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে সরকারি চুক্তির আওতায় কুয়েতে শ্রমিক নিতেন তিনি। তদন্তে বের হয়ে আসে, ভিসা জালিয়াতি করে ওই শ্রমিকদের কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চুক্তিতে তাদের নির্ধারিত বেতনের চেয়ে কম বেতন দেয়া হতো তাদের। সূত্র আরো জানিয়েছে, অভিযুক্ত তিন ব্যক্তি বাংলাদেশে ভিসা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে সিআইডি কর্মকর্তারা। আরো জানিয়েছে, বাংলাদেশে তাদের বড় ধরনের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাদের হয়ে কাজ করেন অনেক কর্মী। তদন্তে আরো বের হয়ে আসে, গড়পড়তা শ্রমিক প্রদানের জন্য ওই নেটওয়ার্কের প্রতি কর্মীকে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ দিনার করে পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে, ড্রাইভার ভিসা বিক্রি করা হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩০০০ দিনার করে।