ব্রেকিং নিউজ
Home / অপরাধ জগৎ / পুলিশের জব্দ করা কোটি কোটি টাকার গাড়ির একি হাল

পুলিশের জব্দ করা কোটি কোটি টাকার গাড়ির একি হাল

বছরের পর বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে জং ধরেছে গাড়িগুলোতে। কোনোটির নষ্ট হয়ে গেছে ইঞ্জিন, খুলে পড়েছে চাকা। আবার কোনোটির নেই দরজা-জানালার অস্তিত্ব।

এমন করুণ অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের হেফাজতে থাকা জব্দকৃত অধিকাংশ গাড়ির। মামলা জটের কবলে পড়ে গাড়িগুলো এখন চেনার কোনো উপায় নেই। সুরক্ষিত কোনো স্থাপনা না থাকায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার এসব গাড়ি।

জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়। দীর্ঘ ৩৬ বছরেও জব্দকৃত যানবাহন রাখার জন্য সুরক্ষিত কোনো স্থাপনা করতে পারেনি জেলা পুলিশ। জব্দকৃত যানবাহন রাখতে ডাম্পিং স্টেশন করার জন্য দুই একর জায়গার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে জেলার নয় থানা পুলিশের হেফাজতে বিভিন্ন সময়ে জব্দকৃত প্রায় সাড়ে ৪০০ যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে একটি বাস, ২০টি ট্রাক, ৫২টি মইক্রোবাস, ৪০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ২৩১টি মোটরসাইকেল এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও নৌকাসহ অন্যান্য যানবাহন রয়েছে ৯৫টি।

বিভিন্ন মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) মূলে এসব গাড়ি জব্দ করা হয়। এসব গাড়ির অধিকাংশই হত্যা ও মাদক মামলার আলামত। আর বেশির ভাগ মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে বৈধ কাগজপত্র না থাকায়। জব্দকৃত এসব যানবাহন রাখার জন্য জেলা পুলিশের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা ও স্থাপনা নেই। ফলে অনেকটা অরক্ষিতভাবে থানা ভবনগুলোর আঙিনায় ফেলে রাখা হয়েছে যানবাহনগুলো।

এছাড়া ডাম্পিং স্টেশন না থাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের পেছনে এবং পুলিশ লাইনসেও জব্দকৃত যানবাহন রাখা হয়েছে। এতে করে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে যানবাহনগুলো। আর মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে সচল অবস্থায় নিলাম করা যাচ্ছে না অধিকাংশ যানবাহন। অধিকাংশ মামলা আদালতে এক থেকে ১০ বছর ধরে বিরাচারধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশের মালাখানা সূত্রে জানা গেছে, মাদক বহনের দায়ে মামলা হওয়া যানবাহনগুলোর মালিক পাওয়া যায় না। অনেক মাদক ব্যবসায়ী গাড়ি ভাড়া নিয়ে মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহার করেন। শুধুমাত্র আসামি হওয়ার ভয়ে প্রকৃত মালিকরা গাড়ির মালিকানা দাবি করতে আসেন না। ফলে বাধ্য হয়েই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর আদালতের নির্দেশে গাড়িগুলো নিলাম করে দেয়া হয়।

হত্যা মামলার আলামত হিসেবে জব্দকৃত গাড়িগুলোর মধ্যে কিছু গাড়ি মামলা নিষ্পত্তি শেষে নিলামে তোলা হয় আবার কিছু গাড়ি ধ্বংস করা হয়। আর বৈধ কাগজপত্র না থাকায় মোটরসাইকেলগুলো মালিকের কাছে তুলে দেয়া সম্ভব না হওয়ায় আদালতের নির্দেশে সেগুলোও নিলাম করতে হয়। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হতে যে সময় লাগে তাতে করে যানবাহনগুলো আর সচল থাকে না। তাই নিলামে এসব গাড়ি বিক্রি করে খুব বেশি অর্থ জমা হয় না রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।

সরেজমিন কয়েকটি থানা ভবন ঘুরে দেখা যায়, জব্দকৃত যানবাহনের করুণ অবস্থা। অবহেলায় থানার আঙিনায় পড়ে থেকে যানবাহনগুলোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকায় গাড়িগুলো এখন আর চেনার উপায় নেই। দরজা-জানালা খুলে মাটিতে পড়ে পড়ে রয়েছে। ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে চেসিস নম্বরও মুছে গেছে। প্রায় এক দশক আগের জব্দকৃত গাড়িও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় গাড়িগুলো নিলাম কিংবা ধ্বংস করা যাচ্ছে না।

কোটি কোটি টাকার এই সম্পদ রক্ষার্থে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। আর আদালতে যানবাহন সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলনে আলোচনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সভাপতি ডা. মো. আবু সাঈদ জাগো নিউজকে বলেন, জব্দ করার পর গাড়িগুলো যেহেতু পুলিশের হেফাজতে থাকে সেহেতু সুরক্ষার দায়িত্বও তাদেরকেই নিতে হবে। যদি তাদের আওতায় না থাকে তাহলে জেলা সমন্বয় সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানানো উচিত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এস.এম. ইউসূফ জাগো নিউজকে বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে আমরা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলনে আলোচনা হয়। কিন্তু নিষ্পত্তি দেরি হওয়ার কারণ হলো মামলার সাক্ষীদের যথাসময়ে আদালতে উপস্থাপন করতে না পারা। সতর্ক করার পরও পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার জন্য সঠিক সময়ে উদ্যোগ নেয় না। ফলে বছরের পর বছর মামলাগুলো ঘুরতে থাকে। সাক্ষীদের যথাসময়ে উপস্থাপন করা হলে মামলা জট নিষ্পত্তি হতো

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ যথাসময়ে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। সাক্ষী হাজিরের জন্য পুলিশের একটি সেলও রয়েছে। অতীতের তুলনায় এখন সাক্ষীদের হাজিরার সংখ্যা এবং মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা বেড়েছে। জব্দকৃত গাড়িগুলো রাখতে যে পরিমাণ জায়গা দরকার সেই পরিমাণ জায়গা ও স্থাপনা আমাদের নেই। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, অপরাধের কাজে ব্যবহার করার জন্য গাড়িগুলো রেজিস্ট্রেশন করা হয় না এবং ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর বদলে ফেলা হয়। ফলে সেগুলোর মালিক খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাড়ি জব্দ করার পর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা গাড়িগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। গাড়িগুলো প্রকৃত মালিকের কাছে তুলে দেয়া হবে নাকি নিলাম করা হবে অথবা ধ্বংস করা হবে সেই আদেশও আদালত থেকেই আসে।