ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। বয়সের ভারে ‘ন্যুজ’ প্রভাবশালী এই যুবনেতা এখন অনেকটাই আড়ালে। যুবলীগে তার কথাতেই কমিটি হতো, তার কথাতেই কমিটি ভাঙতো। কেউ পদ পেতো তার ইশারায়। কেউ পদও হারাতো। সংগঠনের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির থাকলেও সব সিদ্ধান্ত নিতেন। তবে এসব এখন অতীত। নেতা-কর্মীরা বলছেন, সম্প্রতি ক্যাসিনো কাণ্ডে যুবলীগে ‘চৌধুরী অধ্যায়ের’ অবিশ্বাস্য পতন হয়েছে। অনেকে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেরও শেষ দেখছেন।
রাজনীতি থেকে নির্বাসনে চলে গেছেন বলে মত সংগঠনটির নেতাকর্মীদের।আওয়ামী লীগ কার্যালয়, যুবলীগের কার্যালয়, আড্ডার প্রিয়স্থান যুব গবেষণা কেন্দ্র কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুকূল্য পেতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক সদস্য ও বিশবসস্ত রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন বলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ওমর ফারুকের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তার ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান স্পষ্ট করেছেন শেখ হাসিনা। তাকে ছাড়াই যুবলীগের জাতীয় কংগ্রেস সম্পন্ন করার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
জানা গেছে, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে আসতে ওমর ফারুককে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। রাজনীতিতে অনেক কাঠখড় পোড়ানো ওমর ফারুককে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ তাকে নিয়ে গেছে প্রভাবশালীদের কাতারে। এক সময় বিড়ির কাচামাল তামাকের বিকল্প ‘টেন্ডু পাতা’র ব্যবসা করেছেন। ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছেন পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ও। বিড়ি শ্রমিক লীগ, জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন, পরে আওয়ামী লীগ হয়ে এসেছেন যুবলীগে। রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে না পারলেও যুবলীগ তাকে সেই অবস্থান দিয়েছে।
ওমর ফারুক চৌধুরী ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহন করেন। সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময় মিয়ানমার থেকে টেন্ডু পাতা আমদানি শুরু করেন তিনি। আশির দশকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে দলটির অঙ্গ সংগঠন যুব সংহতির রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ১৯৯৭ সালে কোষাধ্যক্ষ হন। ২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। এর আগের কমিটিতে কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান।
জানা গেছে, এরশাদ সরকারের সময় থেকে ওমর ফারুকের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ওই সময় থেকে যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি একাধিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবকিছুকে ছাড়িয়ে যেতে থাকেন তিনি। যুবলীগে গড়ে তোলেন নিজের প্রভাববলয়। ওমর ফারুকের ইচ্ছেমতোই চলছিল সব।
তবে সম্প্রতি ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং তাতে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে থাকে। এ সময়ে গ্রেপ্তার হন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও যুবলীগ নেতা পরিচয় দেয়া জি কে শামীমসহ অনেকে। তাদের গ্রেপ্তারের পর আলোচনায় আসে ওমর ফারুক চৌধুরীর নামও।
যুবলীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, যুবলীগে বিভিন্ন কমিটি গঠন ও পদ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন ওমর ফারুক। টাকা নিয়ে পদ দিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন তিনি। পিয়ন থেকে দপ্তর সম্পাদক পদ পান কাজী আনিস। এ নিয়ে সংগঠনের ক্ষোভ থাকলেও ওমর ফারুকের একচ্ছত্র আধিপত্যে এই বিষয় নিয়ে কেউ মুখ খুলতো না। এখন এসব নিয়ে সরব হচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি যুবলীগ চেয়ারম্যানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করা হয়েছে এবং তার বিদেশ যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। সর্বশেষ গণভবনে না যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কার্যত এরপরই তার রাজনৈতিক কারিয়ারের শেষ দেখছেন বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।
ক্যাসিনোকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চলার প্রথম কয়েকদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি থাকলেও ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন ওমর ফারুক চৌধুরী।
আগামী ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও ধানমন্ডি অফিসে নেতাকর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেলেও যুবলীগ চেয়ারম্যানের দেখা মিলছে না। সংগঠনের শেষ দুটি প্রেসিডিয়াম সভাতেও আসেননি।
এই পরিস্থিতিতে রোববার (২০ অক্টোবর) গণভবনে যুবলীগ নেতাদের নিয়ে বসছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে, এ বৈঠকে থাকবেন না সংগঠনটির বর্তমান চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য ভোলা-৩ আসনের সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন।
বুধবার (১৬ অক্টোবর) সম্মেলনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ গণভবনে দেখা করতে গেলে ওমর ফারুক এবং শাওনকে না রাখার নির্দেশনা পান তিনি।
আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, যুবলীগের এ দু’নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং দলীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে৷ ইতিমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীও তাদের বিষয়ে ক্ষুব্ধ। তিনি চান না রোববারের বৈঠকে তারা উপস্থিত থাকুক। এটি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী আরেক সদস্য বলেন, যুবলীগের বর্তমান কমিটি থেকে বেশিরভাগ নেতা এবার বাদ পড়বেন। চলমান দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যুবলীগের নেতারাই বেশি ধরা খেয়েছেন। তাই এ সংগঠনের নেতারা বাদের তালিকায় বেশি থাকবেন। তাছাড়া বয়সের কারণেও বাদ পড়বেন অনেক নেতা।
জানা গেছে, সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে যুবলীগের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা জানান, ২৩ নভেম্বরের কংগ্রেসে দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত বিতর্কিত নেতারা ছিটকে পড়বেন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও ২০১২ সালের ১৪ জুলাই যুবলীগের সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন ওমর ফারুক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন হারুনুর রশীদ।