ব্রেকিং নিউজ
Home / প্রচ্ছদ / এটিএম জালিয়াত চক্রকে ঢাকায় নিয়ে আসে লন্ডন প্রবাসী নাবির

এটিএম জালিয়াত চক্রকে ঢাকায় নিয়ে আসে লন্ডন প্রবাসী নাবির

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: এটিএম জালিয়াত চক্রকে ঢাকায় নিয়ে আসে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক ফরিদ নাবির। জালিয়াতি চক্রের হোতা পিটারের সঙ্গে ইউরোপের একটি বারে পরিচয় হয় তার। সেখান থেকেই সখ্য। শেষে দুই প্রতারক মিশে যায় একসঙ্গে। পরে ফরিদ নাবিরের হাত ধরেই বাংলাদেশে আসে এটিএম জালিয়াতির অন্যতম হোতা পিটার ও তার সহযোগীরা। গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা পোলিশ নাগরিক পিটার এসব তথ্য জানিয়েছে। পিটারের দেয়া তথ্য মতে, গত এক বছর ধরে জালিয়াতির টাকাতেই চলতো তার বিলাসী জীবন। ডেবিট কার্ড জালিয়াতি করে টাকা তোলার বাইরে বিদেশি ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। পিটারের চার বন্ধু ও ফরিদ নাবির মিলে এই টাকা ভাগাভাগি করে নিতো। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শাজাহান বলেন, পিটারের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রয়োজনে পিটারসহ সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তাকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে পিটার জানিয়েছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক ফরিদ নাবিরই তাকে বাংলাদেশ চিনিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। জার্মানির একটি বারে ফরিদ নাবিরের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ধীরে ধীরে বন্ধু হয়ে যায় তারা। পরবর্তীতে ফরিদের সঙ্গে তার জালিয়াতি কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে পিটার। এরপর ফরিদই তাকে বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা কম জানিয়ে তাকে বাংলাদেশে আসার প্রস্তাব দেয়। সেই সূত্রে দুজনে মিলে ২০১৪ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকায় এসে গুলশানের হোটেল হলিডে প্লানেটে উঠে।
জিজ্ঞাসাবাদে পিটার জানিয়েছে, জালিয়াতির টাকা তার বিদেশি বন্ধুরাসহ ফরিদ নাবিরও নিয়ে গেছে। কিন্তু কে কত টাকা নিয়ে ভেগেছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি  সে। একমাত্র রোমিও নামে বুলগেরিয়ান বন্ধু যাওয়ার সময় ২৫ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যায়। এছাড়া, ইউক্রেনের বন্ধু এন্ডারসন ওরফে এ্যান্ডিও প্রায় সমপরিমাণ ডলার নিয়ে গেছে। তবে কয়েক মাস আগে চলে যাওয়া রোমানিয়ান দুই বন্ধু কত টাকা নিয়ে ভেগেছে তা জানাতে পারেনি সে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পিটার তাদের জানিয়েছে, ডেবিট কার্ড দিয়ে টাকা উত্তোলনের চাইতে শত গুণ বেশি জালিয়াতি করেছে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। কিন্তু এসব কার্ড ছিল বিদেশ থেকে আনা আন্তর্জাতিক ট্রানজেকশন হয় ব্যাংকের গ্রাহকের তথ্যে তৈরি করা। যে কারণে সেসব কার্ড দিয়ে মার্কেট থেকে শুরু করে, হোটেল-বার-রেস্তরাঁ সব জায়গাতেই খরচ করতো। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ক্ষেত্রে সে কিছু ‘পস মেশিন’ ওয়ালা প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের লোকজন নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে পিটারের জালিয়াতিতে সহায়তা করতো।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পিটার ও তার চক্রকে জালিয়াতি করতে সব ধরনের সহায়তা করে ফরিদ নাবির। তিনি নিজেই সিটি ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের লোকজনের সঙ্গে পিটারের পরিচয় করিয়ে দেয়। ফরিদ গুলশানের হলিডে প্লানেট হোটেলে ওঠার সময় সিলেটের যে ঠিকানা দিয়েছিলো তা ভুয়া বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তবে ফরিদের লন্ডনের ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে। ফরিদ নাবির মূলত ব্যবসার আড়ালে জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে কাজ করে থাকে। লন্ডনে তার নাবির ফাউন্ডেশন, লেট ব্রিটেইন ইন্টারন্যাশনাল, লক্ষ্য বে হোটেল, স্যাফরন লিমিটেড, অ্যালিয়েন্স গ্রুপ, অ্যালিয়েন্স হোমস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৮০ সালের অক্টোবরে জন্ম নেয়া ফরিদ নাবিরের আদি বাড়ি বাংলাদেশের সিলেটে। সেই হিসেবে  সে মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে আসতো। নাবির ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে  সে বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। নাবির ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে এসব অর্থ বাংলাদেশি পথশিশু, গরিব পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। গত বছর ফরিদ নাবির উদ্যোক্তা হিসেবে লন্ডনের বার্মিংহামে দেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বৃটিশ বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করে। সে অনুষ্ঠানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও উপস্থিত ছিলেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ইতিমধ্যে ফরিদ নাবিরের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। খুব শিগগিরই তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলে নোটিশ  জারি করবেন। ফরিদ নাবির মূলত নানারকম ব্যবসার আড়ালে জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও পিটার ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সে বিভিন্ন দেশে জালিয়াতি করেছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, পিটারের দেয়া তথ্যে তার এই চক্রের সঙ্গে অনেক ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তার পাশাপাশি পুলিশের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সখ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। পিটারের জালিয়াতিতে তারা কোনো ধরনের সহযোগিতা করেছেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গুলশান বিভাগের একটি থানার পরিদর্শক মর্যাদার এক কর্মকর্তার সঙ্গে পিটারের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। ওই কর্মকর্তাকে ইতিমধ্যে গুলশান বিভাগ থেকে বদলি করে দেয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি কেউ। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বিষয়টির তদন্ত চলছে। সময় হলেই সব প্রকাশ করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ১২ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানী ও মিরপুর এলাকার বিভিন্ন বুথ থেকে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের টাকা খোয়া যায়। গ্রাহকের কাছে ডেবিট কার্ড ও পাসওয়ার্ড গচ্ছিত থাকলেও তাদের মোবাইল ম্যাসেজে টাকা উত্তোলন হওয়ার নোটিফিকেশন আসে। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা নিজ নিজ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানালে বিষয়টি সবার নজরে আসে। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পায়। এর প্রেক্ষিতে গত শুক্রবার ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল)-এর পক্ষ থেকে বনানী থানায় তথ্য-প্রযুক্তি আইন ও পেনালকোডের ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ইউসিবিএলের পক্ষে মামলাটি দায়ের করেন ব্যাংকের হেড অব ফ্রড কন্ট্রোল অ্যান্ড ডিসপুট ম্যানেজমেন্ট ও কার্ডস, ব্রাঞ্চেস কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন কর্মকর্তা মাহবুব-উল ইসলাম খান। এছাড়া সিটি ব্যাংকের পক্ষ থেকেও পল্লবী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুটো মামলাই তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ- ডিবি।

সূত্র: মানবজমিন