ব্রেকিং নিউজ
Home / প্রচ্ছদ / রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ‘ডিজব্যান্ড র‌্যাব’ নামে দেশেবিদেশে স্বাক্ষর অভিযান

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ‘ডিজব্যান্ড র‌্যাব’ নামে দেশেবিদেশে স্বাক্ষর অভিযান

photoড. এম মুজিবুর রহমান

গত ২৮ মে লন্ডনে ‘বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের ৩৩তম শাহাদত বার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রথম স্বাক্ষর দিয়ে ‘ডিজব্যান্ড র্যাব’ নামে দেশেবিদেশে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান কর্মসূচি শুরু করেন। তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমনে বিএনপির শাসনামলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এলিট ফোর্স র্যাব। র্যাব প্রতিষ্ঠার পর দেশের সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিংশ্বাস ফেলেছিল আর সন্ত্রাসীরা ছিল আতঙ্কে। অথচ আওয়ামী লীগের অবৈধ শাসনামলে র্যাবের ভয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে আর সন্ত্রাসীরা নিরাপদে। এখন আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পক্ষ হয়ে র্যাব টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে, গুম অপহরণ করে, এই অভিযোগ সাধারণ মানুষের। তিনি বলেন, বিরোধী দলকে দমনের জন্য কারো মেয়ের জামাই, কারো ভাই, আত্মীয় স্বজন কিংবা দলীয় ক্যাডার দিয়ে র্যাবকে পরিণত করা হয়েছে শেখ হাসিনার রক্ষী বাহিনীতে। জনগণের কাছে আওয়ামী রক্ষী বাহিনীর বিকল্প হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই র্যাবের প্রতি জনগণের আর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। এই র্যাবকে বিলুপ্ত করা এখন জনগণের দাবি।
রেব ও রক্ষী বাহিনী নিয়ে একটু আলোকপাত করলে এটা খুব সহজেই অনুধাবন করা যাবে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যটি আজকে দেশের জনগনের মনের কথা। গুম-খুন-অপহরণ এখন দেশের নিত্যদিনের চিত্র। এই সরকারের কোন জনসমর্থন নেই। প্রশাসনের দলবাজ কর্মকর্তাদের উপর নির্ভরশীল। তারা সম্পুর্ণভাবে নির্ভরশীল আইনশৃংখলাবহিনীর উপর । ভিন্নমতের মানুষকে খুন গুম অপহরণ করে এই সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন তারা দমিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করছে। তাই আইনশৃংখলা বাহিনীর উপর এখন সরকারের নিয়ন্ত্রন নেই বরং সরকারকেই তারা নিয়ন্ত্রন করছে। এটি শেখ হাসিনার ক্ষমতা সাময়িকভাবে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য সহাঢত হলেও দেশের হন্য ভালো নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ, যারা খুবই প্রশিক্ষিত তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া এসব গুম-খুনের কাজ হয় না। বর্তমানে র‌্যাব বিরোধীদল দমনে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে বয়োবৃদ্ধদের গল্পের সেই রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে যেখানে মৃত্যুদন্ডকেই বর্বর শাস্তি হিসেবে গন্য করা হয়, সেখানে বিচার ছাড়াই একটা মানুষ ধরে গুলি করে মেরে ফেলা মধ্যযুগীয় বর্বরতা ছাড়া আসলে আর কিছূই নয়। এমন অনেকেই ক্রসফায়ারে পড়েছে যাদের অপরাধের দন্ড কোনমতেই মৃত্যু নয়। সবচেয়ে যেটি বড় কথা, বিচার বর্হিভুত এইসব হত্যকান্ডে আমাদের আসলে জানার উপায় নেই যে মৃত লোকটির দোষ আসলে কি ছিল, তার মৃত্যুর পর তার পাশে রিভলবার রেখে তাকে পুরনো কটা কেসে রাতে রাতে ঢুকিয়ে দিলে পরদিনের পত্রিকায় মানুষ মৃত লোকটি নিরীহ হলেও তাকে বড় সন্ত্রাসীই ভাববে। এমনটি হয়ত ঘটে না বা খূব কম ঘটে , কিন্তু ক্রসফায়ারকে বৈধতা দিয়ে আমরা সেই কাজটিই করে যাচ্ছি। রাজনৈতিক ভাবে ক্রসফায়ারকে ব্যবহার করলে এরচেয়ে বড় নির্মম অস্ত্র আর হয় না।
নিউইয়র্কভিত্তিক প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৮ মে বাংলাদেশ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে র‌্যাব ও ডিজিএফআই’র বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও অন্যান্য কার্যক্রমের তীব্র নিন্দা করে সংস্থা দুটি ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। সংস্থাটি ‘অন্ততপক্ষে’ তাদের কার্যক্রম তদারকের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের পরামর্শ দেয়।

প্রতিবেদনে গত ৫ বছরে অন্তত এক হাজার বিচার-বহির্ভূত হত্যার সঙ্গে র‌্যাব ও পুলিশ জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। একহাজারেরও বেশী মানুষকে হত্যা হয়েছে, তাদের সবাই কি আসলে সেরকম ছিল যে তারা সমাজে বসবাসের জন্য বিপদজনক?
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।এশিয়া মহাদেশের আঞ্চলিক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে দেয়া এক খোলা চিঠিতে বলেন,
১. প্রধানমন্ত্রীকে এখন অবশ্যই বৃহত্ পরিধিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব নিতে হবে এবং শুধু নারায়ণগঞ্জই নয়, র্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা সবগুলো অভিযোগের বিষয়েই স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।
২. ব্র্যাড অ্যাডামস লিখেছেন, র্যাবকে ভেঙে দেয়া উচিত ও এর পরিবর্তে একটি সম্পূর্ণ জবাবদিহিমূলক আইন প্রয়োগকারী বাহিনী গঠন করতে হবে, যারা আইন ও বহিঃস্থ পর্যবেক্ষণের আওতায় কার্যক্রম পরিচালনা করবে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, গণতন্ত্রে ডেথ স্কোয়াডের কোনো স্থান নেই।
৩. সংস্থাটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আইনের শাসনের অস্তিত্ব নেই। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে যেভাবে একজন সিনিয়র আইনজীবী ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে ২৭ এপ্রিল অপহরণের পর হত্যা করেছে বলে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তা আবারও প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে আইনের শাসনের অস্তিত্ব নেই। এক মন্ত্রীর পরিবার সদস্যদের এই কাজের পরিকল্পনা করা, অপহরণের বিষয়টি জেনেও পুলিশের নিষ্ক্র্রিয় থাকা এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে লোক দেখানো কার্যক্রমে ভয়ের হীম হাওয়া বইয়ে দেয়। বাংলাদেশে রক্ত ও সম্পদের রাজনীতি দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরাজ করছে, আইনের শাসনের কোনো অবকাশই নেই। বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী ব্যবস্থায় ‘চেইন অব কমান্ডের’ স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ‘চেইন অব করাপশন’।
৪. মানবাধিকার সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জভিত্তিক র্যাব-১১-এর কমান্ডার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ বর্তমান সরকারের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন। মায়ার ছেলে দীপু চৌধুরীই এই অপহরণের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। দীপু চৌধুরীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমানের অনুগত নূর হোসেনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। নূর হোসেনের সঙ্গে নজরুলের বিরোধের জের ধরে হয় এই গুম ও খুন।
৫. এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়, এই শামীম ওসমান এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবিও করেছেন যে র্যাব সাতজনকে অপহরণ করার ১০ মিনিটের মধ্যে তিনি টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি অভিহিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী, যিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে রয়েছেন, শামীমের এই বক্তব্য অস্বীকার করেননি। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অপহৃত সাতজনের জীবন বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে এই সাতজনের খুনে সরকারের হাত রঞ্জিত। অব্যাহত গণচাপের কারণে সরকার নারায়ণগঞ্জ থেকে শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে। এদের মধ্যে রয়েছেন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি), সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসপি) এবং র্যাব-১১-এর তিন কর্মকর্তা। এই তিন কর্মকর্তা হচ্ছেন লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এস এম মাসুদ রানা।
৬. প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হয়, র্যাবের এই তিন কর্মকর্তাই কি সাতজনকে অপহরণ ও খুন করেছিল? এই অপরাধে র্যাবের এক ডজনেরও বেশি লোকের সম্পৃক্ত থাকার আশঙ্কা থাকলেও সরকার তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মকর্তা, তাদের সহযোগী ও পরিবারবর্গ দেশের সংবিধান ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ আইনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করা হয়ে থাকে।
৭. প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিনই র্যাব ও পুলিশের ডিবির কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের লোকজন নাগরিকদের অপহরণ করছে। এ ধরনের কোনো ঘটনারই বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়নি।
অপহরণের পর খুব কম ক্ষেত্রেই অপহৃত ব্যক্তি জীবিত ফিরে আসতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে অপহৃত ব্যক্তি ও তার পরিবার সাধারণ আরও বেশি আতঙ্কে থাকেন। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় কেউই অপহরণের কথা প্রকাশ্যে বা গোপনে বলতে সাহস পান না। অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আলোচনা কেবল নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাতজনের নিহত হওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকা উচিত নয়। এম ইলিয়াস আলী, মোহাম্মদ সেলিম মিয়া, ইমাম হোসেন বাদল, চৌধুরী আলম, ব্রিটিশ বাংলাদেশী যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান মুজিব সহ আরও অনেকে গুমের শিকার হয়েছেন। গত আট বছরে শত শত লোক অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এদের সবার কথাই আলোচনা করা উচিত। তাদের পরিবারবর্গ সরকার বা বিচার বিভাগের কাছ থেকে কোনো জবাব পায়নি। বাংলাদেশে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণকে পথ খুঁজে নিতে হবে।
একের পর এক বিচারবহির্ভুত নৃশংস এ হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন মহল কথিত ক্রসফায়ার বন্ধে দেশে-বিদেশে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তবে এসবকে অগ্রাহ্য করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর্এ অপকর্মকে সরকার নীরবে সমর্থন করে চলেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সরকার বিচার ও মানবাধিকার বহির্ভুত এ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ঘাতকদের প্রতিনিয়ত উস্কে দিচ্ছে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আইনের শাসনের প্রতি অনুগত নয়। তারা দুর্নীতির শৃঙ্খলের প্রতি অনুগত। আর এই দুর্নীতির শৃঙ্খলই জাতিটির টুটি চেপে ধরেছে, জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে আইনের শাসনের সম্ভাবনাকে নস্যাত্ করে দিয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, সরকার অপহৃত লোকগুলোকে রক্ষার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারের হাত নারায়ণগঞ্জে নিহত সাতজনের রক্তে রঞ্জিত।

গত কিছু দিনের কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গুম খুন অপহরণের সঙ্গে কেবল র‌্যাবই নয়, দেশে গুম খুনের সঙ্গে আওয়ামিলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।
১. সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনী নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ২৪ ঘন্টার মধ্যেই হত্যাকারীরা ধরা পড়বে। এরপর হাজার ঘন্টা পার হলেও এই ঘটনার রহস্য বের হয়নি। আমি নিজে টেলিভিশনে দেখেছি, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, সাগর রুনী হত্যা মামলার সরাসরি তত্ত্বাবধান করছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তত্তা¡বধান করার পরও সাগর রুনী হত্যা মামলার রহস্য বের না হওয়ায় প্রমাণ করে এসব অপরাধের সাথে তার দলের বা সরকারের লুকজন জড়িত অথবা এ ধরনের কর্মকান্ধকে বন্ধ করার উপায় তার জানা নেই। ।
২. ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়নগঞ্জে সাতজনকে দিনে দুপুরে গুম করে হত্যা করে পেট কেটে তাদের লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। ওই এলাকার একজন অনির্বাচিত এমপি বলেছেন, নারায়নগঞ্জে অপহরণের পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন। শেখ হাসিনাকে জানানোর পরও সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে নদী থেকে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে জানার পরও অপহৃতদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়ায় এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার দায় তিনি কোনভাবেই এড়াতে পারেননা।
গত ৫ মে নজরুল সহ ৭ খুনের গঠনায় যার সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে করা হচ্ছে সেই শামিম ওসমান বলেন ‘আমি শামীম ওসমান, আমি কাউরে কেয়ার করি না, আমি আজ থেকে আর নম্র-ভদ্র থাকবো না, আমার শক্তি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’
গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য প্রয়াত নাসিম ওসমানের ওপর আলোচনায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথাও তুলে ধরে তাদের পাশে থাকবেন বলেও জানিয়েছেন। 
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছে এই ওসমান পরিবারে। এখানে দল গঠন থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি হয়েছে। রাজনীতির নীতি আদর্শ নিয়ে চলতেন জোহা কাকা। এই পরিবারের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল সব সময়। যদি তাদের প্রয়োজন হয় দেখাশোনা করব।’
৩. চলতি মে মাসে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে গুলী করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বিকেলেই শেখ হাসিনার অফিস থেকে বিবৃতি দিয়ে হত্যাকান্ড সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বলে আইন শৃংখলাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করা হয়। অথচ দেখা যায়, যারা গ্রেফতার হয়েছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মী। দেখা যায়, এভাবেই প্রতিটি গুম খুন অপহরণের সঙ্গেই শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।
৪. ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতের আঁধারে ঢাকার বনানী থেকে গুম হন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সাংসদ এম ইলিয়াস আলী। গুমের পর থেকে তার জন্য চলছে অপেক্ষা। আওয়ামিলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন রাজনীতির চেয়ে মানবতা বড়। কিন্তু লন্ডনে একটি সভায় আবার বললেন যেভাবে উত্থান সেভাবে পতন। এ ধরনের কথা বলে তার আগর অবস্তান থেকে কেন সরে আসলেন তা আজো পরিস্কার নয়।
শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র কয়েক মিনিটে ১৯৭৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গনতন্ত্রকেও হত্যা করেছিলেন, এমনকি নিজ হাতে কবর দিয়েছিলেন নিজ দল আওয়ামীলীগকে। গঠন করেছিলেন একদলীয় বাকশাল। ইতিহাস সাক্ষী, এরপর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনরায় বাংলাদেশে বহুদলীয় গনতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। সেই বহুদলীয় গনতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বাতিল করা আওয়ামী লীগ নিজ নামে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। এখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বেপরোয়া গুম খুন আর নৃশংসতাকেও হার মানাচ্ছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা।
যেন কিছুতেই থামছে না ক্রসফায়ার নামক মানুষ হত্যার এই মহোতসব। প্রতিদিন পত্রিকা পাতা খুললেই দেখা যায় অমুক সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারে নিহত। তাহলে এদেশে কি বিচার ব্যবস্থা অচল?? সন্ত্রাসী হলেই কি তাকে হত্যা করতে হবে?? এভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড চালিয়ে দেশটাকে ক্রসফায়ারের রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে কিনা এই প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে।

পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী গণতন্ত্রের লেবাসধারী বর্তমান মহাজোট সরকারের মাত্র ১৫ মাসে বিচারবহির্ভুত এ হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ২১৩ জন। একই সময় র‌্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছে আরো তিন শতাধিক।


অধিকারসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৫৯ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকাকালে মারা গেছেন। এর আগে গত এক বছরে র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কথিত ক্রসফায়ারে মারা গেছে ১৫৪ জন। তাদের মধ্যে র‌্যাবের হাতে, ৪১, পুলিশের হাতে ৭৫, যৌথভাবে র‌্যাব-পুলিশের হাতে ২৫, সেনাবাহিনীর হাতে ৩ এবং আনসারের হাতে ২, জেল পুলিশের হাতে ১, বনরক্ষীদের হাতে ১, বিডিআরের হেফাজতে ৫ এবং কোস্টগার্ডের হাতে ১জন নিহত হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সূত্র থেকে জানা গেছে। 

এ বিচারবহির্ভুত ক্রসফায়ারের মৃত্যুর মিছিল দিন দিন যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে চলেছে। তাই বিচারবহির্ভুত তথাকথিত এ ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-খুন আর চলতে দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে দেশের সচেতন মহল ও মানবাধিকার সংগঠনসমূহকে ক্রসফায়ার বন্ধে সরকারের প্রতি আরো বেশি কঠোরভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
আইন শৃংখলাবাহিনীর কাজ জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অথচ তারাই এখন জড়িয়ে পড়েছে গুম খুণ অপহরণের সঙ্গে। জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো এলিট ফোর্স র‌্যাব। ‌্যাব যখন গঠন করেছিল তখন এ বাহিনীর সুনাম ছিল। অতীতে র‌্যাবের সুনাম থাকলেও এখন তা নেই। র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর দেশের সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিংশ্বাস ফেলেছিলো আর সন্ত্রাসীরা ছিলো আতংকে। অথচ আওয়ামী শাসনামলে এখনকার চিত্র সম্পুর্ণ উল্টো। র‌্যাবের ভয়ে এখন সাধারণ মানুষ আতংকে আর সন্ত্রাসীরা নিরাপদে। সন্ত্রাসী, আওয়ামী লীগ এবং র‌্যাব এখন একাকার। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পক্ষ হয়ে এখন টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে র‌্যাব। র‌্যাবকে পরিণত করা হয়েছে স্বাধীনতার পর জনগণের আন্দোলন দমন করতে সৃষ্ট সন্ত্রাসী রক্ষী বাহিনীর বিকল্প হিসাবে। কারো মেয়ের জামাই, কারো ভাই আত্মীয় স্বজন কিংবা দলীয় ক্যাডার দিয়ে র‌্যাবকে পরিণত করা হয়েছে শেখ হাসিনার ব্যাক্তিগত বাহিনীতে। র‌্যাব এখন ভিন্নমত দমনে ব্যস্ত। তাই জনগণের কাছে আওয়ামী রক্ষীবাহিনীর বিকল্প হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই র‌্যাবের প্রতি জনগণের আর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। এই র‌্যাবকে বিলুপ্ত করা এখন জনগণের দাবী। সময়ের দাবী।
ড. এম মুজিবুর রহমান
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহ জালাল (রহ.) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট